নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০১ আগস্ট, ২০১৭

ইসির সঙ্গে বিশিষ্টজনদের সংলাপ

সেনা ও ‘না’ ভোট চালুর পরামর্শ

একাদশ সংসদ নির্বাচন ভয়মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের তাগিদ দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ ঘোষিত রোডম্যাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে তারা এ মত তুলে ধরেন।

তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে নির্বাচন ভবনে এ সংলাপে আমন্ত্রিত ৫৯ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই উপস্থিত ছিলেন না।

সংলাপে অংশ নেওয়া একাধিক বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, সংলাপে হলফনামায় প্রার্থীর দেওয়া তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করা, প্রশাসন ঢেলে সাজানো, মনোনয়ন বাণিজ্য নজরদারি করা, প্রবাসীদের ভোটার করা-এ ধরনের সুপারিশও এসেছে। নির্বাচনকালীন সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছে। আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল না। এ জন্য অনেকে লিখিত বক্তব্য জমা দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে লিখিত মতামত দেওয়ারও সুযোগ রেখেছে কমিশন।

এ ছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে বলেছিলেন, তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসির কিছু করার নেই-এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেন নাগরিক সমাজের বেশির ভাগ প্রতিনিধি। তাদের বেশির ভাগই ভয়মুক্ত নির্বাচনের জন্য সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। তবে দুজন সাবেক আমলা সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েনের পক্ষে মত তুলে ধরেন। ‘না’ ভোটের পক্ষে বেশির ভাগ মত দিলেও একজন ছিলেন এর বিরোধী। সূত্র জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইসি কোনো বক্তব্য খ-ন করতে যায়নি। তারা শুধু বক্তব্য শুনেছে।

সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ আগামী দিনগুলোতে যাদের সঙ্গে বসব তাদের সুপারিশও একত্র করে বই আকারে প্রকাশ করব। আগামী জানুয়ারি মাসের দিকে তা সরকার ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।’

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন-নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন। সংলাপ সঞ্চালনা করেন ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান। সংলাপে আমন্ত্রিত ৫৯ জন অতিথির মধ্যে ৩৪ জন উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে আমন্ত্রিতদের বাইরে দুজনের উপস্থিতি নিয়ে শোরগোল সৃষ্টি হয়।

সেনা মোতায়েন : সুশীলসমাজের সঙ্গে ইসির সংলাপে গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন। বেশির ভাগই সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ (আরপিও) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, আর্মড পুলিশ, র?্যাব, আনসার, বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বোঝানো হয়েছে। এতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্রবাহিনীর কথা নেই। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সশস্ত্রবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’, তারা ক্যাম্পে অবস্থান করবে, প্রয়োজনে তাদের ডাকা যাবে।

তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১৯ আগস্ট এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্রবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্রবাহিনী নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা পালন করে। ২০১৩ সালে আরপিও সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্রবাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দীন খান সাংবাদিকদের বলেন, সব দলকে ভোটে আনতে হবে এবং এ জন্য সবার সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। আইনে ঘাটতি থাকলে প্রয়োজনে তার সংস্কার করা দরকার। ইসির উচিত সরকারকে বলা তারা কী করতে চায়। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই তাদের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। যারা অভিবাসী তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ভোটের আগে বিশৃঙ্খলায় ভোটকেন্দ্র বন্ধে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বেশ কিছু ধারা আছে, সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে সবাই একমত। তবে কোন প্রক্রিয়ায় মোতায়েন হবে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। ধর্মীয় সভা যাতে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার না হয়-সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ইসির আন্তরিকতাই যথেষ্ট নয়, সক্ষমতা ও সৎসাহস দেখাতে হবে। তিনি নির্বাচনে আইসিটির অপব্যবহার রোধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রশাসনে দলীয়করণ যাতে কমানো যায় তার জন্য ইসিকে ক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন না করার ব্যাপারেও পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন বেশ কিছু মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে আনতে হবে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, নির্বাচন হচ্ছে ‘সুপার পলিটিক্যাল ইভেন্ট’। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলো ফল ঘরে তোলে। তাই শুধু টেকনিক্যাল নয়, নির্বাচনকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে নিতে হবে। এখনকার সংকট দূর করে নির্বাচনী কৌশলে আসতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান চালু করতে হবে, পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীন হতে হবে। সাহসী হতে হবে। পানামা পেপারসে যে ১১ জনের নাম এসেছে তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। একইভাবে জামায়াতসহ স্বাধীনতা-বিরোধিতায় জড়িতরা নির্বাচনে যেন অংশ নিতে না পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে। তাদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে আনাটা ঠিক হবে না।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দরকার। প্রশিক্ষণ থাকলে ৭৫ শতাংশ অনিয়ম দূর করা সম্ভব। কমিশনের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিবন্ধী ও বেদে সম্প্রদায়ের চাহিদা ও বিশেষ প্রয়োজন মিটিয়ে নির্বাচনে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পক্ষপাতিত্ব না করে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সবার জন্য নির্বাচনে সমান সুযোগ নিশ্চিত না করতে পারলে আইন ভঙ্গের জন্য নির্বাচন কমিশন জাতির কাছে দায়ী থাকবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত অলিউর রহমান বলেন, আলোচনায় মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছে তত্ত্বাধায়ক সরকার আনা হোক; আমরা বলছি, এটা আনা সম্ভব না, এটা ডেড ইস্যু। আর্মি নিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে; আমরা বলেছি তাদের ম্যাজিস্ট্রেশিয়াল পাওয়ার দেওয়া ঠিক হবে না; আর্মিকে ভোটে আনার দরকার নাই। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কথা উঠেছে, আমরা বলেছি ভেঙে দেওয়া যাবে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রের টাকায় পরিচালিত মিডিয়ায় সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ‘না’ ভোটের বিধান প্রবর্তন না করার পক্ষে মত দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী বলেন, ‘সবাই ভবিষ্যতে ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছি। সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। সবার অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে পরামর্শ দিয়েছি। সংলাপে “না” ভোটের বিষয়টি আলোচনায় আসে। ইসি বলেছে, কেউ ভোট দিতে না গেলে তা “না” ভোট। কিন্তু তা নয়। “না” ভোটের বিধান থাকলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অনেকে “না” ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক টিম নিয়োগ করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনা মোতায়েনের বিকল্প নেই। সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করার প্রস্তাব করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কাজই জনগণের মতকে তুলে ধরা। ভোটার হালনাগাদ ও সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কথা বলেছি। নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসীদের ভোটদানের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথাও বলা হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, কমিশনকে তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধারে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবাইকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে।

তিনি বলেন, ইসি কোনো ইস্যু রেইজ (উত্থাপন) করেনি, তারা বলতে দিয়েছে। ইসিকে তার ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে হবে, বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে। সকল দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে হবে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের মনে যে ভয়ভীতি রয়েছে তা দূর করতে হবে।’

২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে গত ১৬ জুলাই দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে ইসি। এর অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছে ইসি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist