হাসান ইমন

  ২৭ জুলাই, ২০১৭

জলাবদ্ধ দুই মহানগর

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত পাঁচ বছরে ব্যয় করেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২১ কোটি টাকায় দুটি মেশিনও কেনা হয়েছিল। গত দুই যুগে ওয়াসাও ব্যয় করেছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দূর হয়নি জলাবদ্ধতা। একইভাবে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া মাস্টারপ্ল্যান গত ২২ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার নামে ব্যয় হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। ড্রেনগুলো খোলেনি। ১২টি সøুইস গেট ও পাম্প স্টেশনের একটিও নির্মাণ হয়নি। বরং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বেড়েছে জলাবদ্ধতা। গত দুই মাসে ছয় বার জলাবদ্ধতায় পড়েছে এখানকার মানুষ। এমনকি দুই নগরীর ড্রেনগুলো ১০ মি.মি. বৃষ্টিপাতের বেশি ধারণ করতে পারছে না। কিন্তু কেন এই জলাবদ্ধতা ও সমাধানইবা কোন পথে- এ নিয়ে কথা বলেছেন নগরবিদরা।

ঢাকা

হাজার কোটি টাকা ব্যয়েও মিলছে না সমাধান

ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে আড়াই হাজার কিলোমিটার। এসব ড্রেন ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি ধারণ করতে পারে। অথচ গত রোববার বৃষ্টি হয়েছে ২০ মিলিমিটার (মি.মি.), সোমবারে ২৮ মি.মি., মঙ্গলবার ৫৪ মি.মি. ও গতকাল ৬৭ মি.মি.।

গত চারদিনে রাজধানীতে ১৬৯ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়। অর্থাৎ, ড্রেনগুলোর যে পরিমাণ বৃষ্টি ধারণ ক্ষমতা, সে হিসাবে ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার করে গত চারদিনে ৯৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ার কথা নয়। অথচ গত চার দিনে মাত্র ১৬৯ মি.মি. বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা। অর্থাৎ নগরীর ড্রেনগুলো ন্যূনতম ১০ মি.মি. বৃষ্টিও ধারণ করতে পারছে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার জলাবদ্ধতা যেন নিয়মিত রূপ নিয়েছে। গত কয়েকদিন বৃষ্টির সময় যাচ্ছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত। জমে থাকা পানি ঢুকে পড়ছে বাসাবাড়িতে, রাস্তার পাশের দোকানপাটে। পানিতে তলিয়ে থাকায় অলিগলি থেকে প্রধান সড়কে আসতে হচ্ছে ভ্যানে বা রিকশায়। কোথাও কোথাও সিএনজি, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল পর্যন্ত চলতে পারছে না। পানিতে মিশছে ভুগর্ভস্থ মলমূত্র। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন।

অথচ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বিগত পাঁচ বছরেই পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম চালাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ যুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে, রাজধানীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ বিভাগের মাধ্যমে দুই যুগে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সংস্কার ও উন্নয়নকাজ করেছে। কিন্তু দূর হচ্ছে না জলাবদ্ধতা।

এদিকে, জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দূষছেন ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এই বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। জলাবদ্ধতা যেসব কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সেসব কারণগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। এরপর জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতিমধ্যেই, শান্তিনগর, নাজিমউদ্দিন রোড, মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় ড্রেন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

আর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, শুধু বর্ষা নয়, যেকোনো সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে কিছু সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবেই। কারণ বর্তমানে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার পক্ষে ১০ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব নয়। তিনি অবিলম্বে নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবহমান খালগুলো উদ্ধার ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি গুরুত্ব দেন। তিনি আরো বলেন, এ বছর মোট ১৮টি খাল পরিষ্কার করেছি। কিন্তু খাল পরিষ্কারের ছয়-সাত দিন পরই আবার যা তাই অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক স্থানে খাল দখল হয়ে গেছে। খালের মধ্যে চার-পাঁচ তলা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। ভাঙতে গেলে কাগজপত্র দেখায়।

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নগরবিদরা। তারা জলাবদ্ধতার জন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, অপরিকল্পিত ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং নগরীর খালগুলো বেদখল হওয়াকে দায়ী করছেন। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর খালগুলো হারিয়ে যাওয়ায় নগরীতে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাকৃতিক খালগুলো উদ্বারের ব্যবস্থা না করা হলে এই ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। তিনি জলাবদ্ধতার জন্য ওয়াসাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ওয়াসা ড্রেনেজ লাইনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায়ও বৃষ্টির পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য দুই সিটি করপোরেশন অনেকাংশ দায়ী। তারপরেও সবগুলো সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে জলাবদ্ধতা দূর করতে পারে।

জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে নগরবিদ ও জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেম বিনষ্ট করে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, পানি প্রবাহের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া, অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে বক্স কালভার্ট নির্মাণ, খাল-জলাশয় জবরদখল ও ভরাটের কারণে পানিতে ডুবছে ঢাকাবাসী। ৭ থেকে ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই পুরো রাজধানীতে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, জলাধার বিলীন, অতিরিক্ত বর্জ্য, বর্জ্য নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনা সংকট, খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

বক্স কালভার্ট নির্মাণে ঢাকা ওয়াসার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নগরবাসীর জন্য আরেক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা কমাতে তিনটি স্থানে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ বক্স কালভার্ট নির্মাণ করেছিল ওয়াসা। কিন্তু আবর্জনা নিয়মিত অপসারণ না করায় এসব বক্স কালভার্টের ভেতরে পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্য জমে নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় রুদ্ধ হয়ে আছে। ফলে জলাবদ্ধতা দূর করার বদলে এসব এখন জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে, গত তিন দিন বৃষ্টি হওয়ায় রাজধানীর মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মিরপুর, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরীর অধিকাংশ এলাকা হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি পর্যন্ত জমে ছিল। এতে কর্মস্থালে যাওয়া যাত্রীরা পড়েন চরম ভোগান্তিতে।

এই বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সম্প্রতি ওয়াসা, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বয় সভা করেছে। ওই সভায় অবৈধ খাল দখল উচ্ছেদ এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist