প্রতীক ইজাজ ও হাসান ইমন

  ২৩ জুলাই, ২০১৭

কমছে নাগরিকসেবা

নাগরিকদের সেবা বাড়াতে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে আলাদা দুটি সিটি করপোরেশনে (উত্তর ও দক্ষিণ) রূপ দেওয়া হয়। টানা সাড়ে তিন বছর অভিভাবকহীন থাকার পর ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল নির্বাচিত নগরপিতা পান ঢাকার মানুষ। দক্ষিণের মেয়র হিসেবে ৬ মে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও ৭ মে উত্তরের মেয়র হিসেবে শপথ নেন আনিসুল হক। এর আগে ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন বিএনপি দলীয় সাদেক হোসেন খোকা। যদিও তার মেয়াদ ছিল ২০০৭ সাল পর্যন্ত, কিন্তু নির্বাচনী জটিলতার কারণে অতিরিক্ত চার বছর নামমাত্র মেয়র পদে থাকেন তিনি।

এক সিটি করপোরেশন দুটোতে উন্নীতকরণের পাশাপাশি বাড়ে সিটি করপোরেশনের আয়তনও। স্বাভাবিকভাবে বাড়ে জনসংখ্যাও। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ছয় লাখ ২৬ হাজার ১৭। আর দক্ষিণের ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৫। অর্থাৎ বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনে মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১। তবে জনসংখ্যার এই হিসাব ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে করা। এরপর ছয় বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে এই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

টানা আট বছর (২০০৭-২০১৫ সাল) নির্বাচিত নগরপিতা না থাকায় দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেমন থেমে ছিল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড; তেমনি সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় বাসিন্দাদের। ফলে ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় ও সমর্থিত দুই নির্বাচিত মেয়র পাওয়ায় আশায় বুক বাঁধে রাজধানীর মানুষ। নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে নানা উন্নয়ন কর্মকা- ও সেবার প্রতিশ্রুতি দেন দুই মেয়রই। কাজেও নেমে পড়েন তারা। কিন্তু মেয়র হিসেবে টানা দুই বছর পার হওয়ার পরও নাগরিক সেবা নিয়ে খুশি হতে পারছেন না রাজধানীর বাসিন্দারা। বরং পুরনো দুর্ভোগের পাশাপাশি নতুন দুর্ভোগ পেয়ে বসেছে তাদের। সর্বশেষ চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব সীমাহীন কষ্টে রেখেছে দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের। মশা নিধন ও মশার প্রজননক্ষেত্রগুলো নষ্ট না হওয়ায় এবং সেদিকে দীর্ঘদিন কোনো নজর না দেওয়ায় এখন ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, শহর জুড়ে জলাবদ্ধতা ও যত্রতত্র বর্জ্যে নাগরিকদের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে। পার্ক ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত হয়নি। যানজট নিরসন, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণ, রাজধানীর গণপরিবহন ও মাংসসহ ভোগ্যপণ্যের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ মৌলিক নাগরিক সেবার অনেক কিছুই পাচ্ছে না বাসিন্দারা। কিছু কিছু এলাকায় জনদুর্ভোগ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে অভিযোগ করছেন নাগরিকরা।

অবশ্য দুই মেয়রের কিছু দৃশ্যমান উল্লেখযোগ্য কাজও রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর সিটির তেজগাঁওয়ে সড়কের ওপরে থাকা অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীর সড়ক থেকে হকার উচ্ছেদ করে রাস্তা প্রশস্তকরণ, সদরঘাট-গাবতলী বেড়িবাঁধ সড়কের উভয় পাশ থেকে ৩৭ একর জমি উদ্ধার, সবুজায়ন কাজের অংশ হিসেবে বৃক্ষরোপণ কাজ উল্লেখযোগ্য। আর দক্ষিণের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে গুলিস্তান ও নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত এবং অবৈধ দখল থেকে গোলাপবাগ মাঠ উদ্ধার, সায়েদাবাদ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ।

তারপরও দুই মেয়রের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারছেন না নাগরিকরা। ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, চলতে-ফিরতে নানা ধরনের দুর্ভোগ অতিষ্ঠ করে তুলেছে সবশ্রেণির মানুষকে। ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। মৌলিক সেবার দাবিতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। স্মারকলিপি দিতে হচ্ছে। সভা-সেমিনারে সমালোচনা হচ্ছে। এমনকি চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে সর্বশেষ এ মাসে দুই মেয়রের ওপর অনাস্থার প্রতীক হিসেবে লাল কার্ড প্রদর্শন করেছেন বেশকিছু নাগরিক। সেবার প্রশ্নে পরস্পরকে দূষছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে রাজনৈতিকভাবেও সমালোচিত হচ্ছেন দুই মেয়র।

কিন্তু কেন দিন দিন নাগরিকদের সেবা কমছে এবং এ সমস্যার সমাধানইবা কী- জানতে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদ কথা বলেন দেশের তিন নগরবিদের সঙ্গে। তারা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করেছেন। তারা বলেন, সেবা বাড়াতে হলে মেয়র ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহির নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে নগরপিতা নির্বাচন করা যাবে না। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে হবে।

এ ব্যাপারে নগরবিদ ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন উন্নয়ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের পৃথক পৃথক কাজের ধীরগতি এখন নাগরিকদের সুবিধা দেওয়ার পরিবর্তে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরস্পরের মধ্যে সমন্বয়হীনতায় সেবাদানে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। কমছে নাগরিক সুবিধাও। তিনি আরো বলেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, যেকোনো মেগাসিটিতে যেখানে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা, সেখানে রাজধানীতে রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। অথচ স্বল্প পরিসর এই রাস্তা জুড়ে চলছে এলোপাতাড়ি খোঁড়াখুঁড়ি। এর ফলে একদিকে যেমন টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না, তেমনি সমন্বয়হীন সেবা প্রদানের ফলে সুবিধার বদলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে। তিনি জানান, এই মুহূর্তে প্রায় ৫৬টি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কারো সঙ্গে কারো কোনো সমন্বয় নেই।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরো বলেন, দুই মেয়র প্রথম বছর যেভাবে কাজ করেছেন, এখন সে তুলনায় তাদের কম মাঠে দেখা যায়। দুই সিটির গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ছিল বর্জ্য অপসারণ, নাগরিকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণ করা। কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই তারা করতে পারেননি। শত শত কোটি টাকা খরচ করে ওয়েস্টবিন (মিনি ডাস্টবিন) স্থাপন করেছিল দুই মেয়র। তদারকির অভাবে সেগুলো হারিয়ে গেছে। তিনি জন্য দুই মেয়রের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং কর্মক্ষমতাকে দায়ী করেছেন। তারমতে, নগরবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতাই দুই মেয়রই ব্যর্থ। কয়েক মাস আগে থেকেই রাজধানীতে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। ওই সময় কোনো মেয়রকেই এই বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। আর এখন ১০ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। তাহলে তিন মাস আগে কেনো মাঠে নামেননি?। ওই সময় মাঠে নামলে তো এতো ভয়াবহ আকার হতো না। আর এতো মানুষ কষ্ট পেতো না। তিনি বলেন, কিছু জায়গায় তাদের প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যে কাজগুলো তাদের করার কথা সে কাজগুলোই তো তারা করছে না। উপরোক্ত কাজগুলোই একান্তই তাদের। এইগুলোতো তারা ঠিকমতো করছে না। যদি কাজ করত তাহলে নগবাসীর আস্থা অর্জন করতে পারত। নগরবাসীর এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।

অপর নগরবিদ ও জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, সিটি করপোরেশনকে আওয়ামী লীগ দুই ভাগ করেছে মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই ভাগের ফলে মাথা ভারী প্রশাসন পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশন এমনিতেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। জবাবদিহি না থাকায় নাগরিকের প্রাপ্য সুবিধা দিতে পারছে না। রাজনৈতিক কারণে ভাগ হওয়ার পর নাগরিক সুবিধা তাই বাড়ছে না। সিটি করপোরেশনকে ভাগ করা ঠিক হয়নি। তার মতে, নগরের জনসংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে নাগরিক সেবার চাহিদা। তাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য যে ধরনের পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা দরকার, সেসব নেই। নাগরিক সুবিধা দেওয়ার সংস্থাগুলোতে অনিয়ম, কোথাও দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা চলছে। এক সংস্থা বা এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় নেই। রাজউক কাজ করছে বিচ্ছিন্নভাবে, তাদের কাজে পরিকল্পনা ও সমন্বয় নেই। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না। ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও ঠিকমতো নিজের দায়িত্ব পালন করছে না। সব সংস্থা বড় বড় কথা বলছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এই নগরবিদ পরামর্শ দেন—যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডের কমিশনারকে ক্ষমতা দিতে হবে। অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মেয়রের হাতে সব ক্ষমতা থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। সব সংস্থাকে নিজের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা দায়িত্বে অবহেলা করছেন, নাগরিক স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারে পরিবেশ ও নাগরিক অধিকারের সংগঠনগুলো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম নওশাদ হোসেন নাগরিক সেবা দিন দিন কমে যাওয়ার পেছনে পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেছেন। পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলেন, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক জটিলতা দুটোই রয়েছে। তবে প্রশাসনিক জটিলতা একটু বেশি। নগরীতে জলাবদ্ধতার জন্য সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউকসহ কয়েকটা সেবাদাতা সংস্থা দায়ী। এগুলো সমাধানের জন্য সবগুলো সংস্থার সমন্বয় দরকার। সবার মাঝে সমন্বয়হীনতা বড় অভাব রয়েছে। নাগরিক সেবার মান বাড়াতে সবগুলো সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। জলাবদ্ধতার নিরসনের জন্য ওয়াসাকে বাদ দিয়ে সিটি করপোরেশন অথবা অন্য কোনো সংস্থাকে লিডিং দায়িত্ব পালন করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই সিটি করপোরেশন ভালোভাবে কাজ করতে হবে।

পিডিএসও/হেলাল​

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সিটি করপোরেশন,নাগরিক সেবা,দুর্ভোগ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist