শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম
জঙ্গল ছলিমপুর
অপরাধীদের অভয়ারণ্য
ছিন্নমূলের নামে পাহাড় কাটার কারণেই বিপর্যয়
পাহাড়ের বিভিন্ন খাঁজে কেটে কেটে গড়ে উঠেছে বসতি। কেউ পাহাড়ের পাদদেশে, কেউবা পাহাড়ের পেটে, কেউবা পাহাড়ের চূড়ায় কেটে কেটে গড়েছে বসতি। এই চিত্র চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের জঙ্গল ছলিমপুরের। ছিন্নমূলের নামে সেখানে দখল করা হয়েছে সরকারি খাসজমি।
জঙ্গল ছলিমপুরের পাহাড়ে আড়াই বছর আগে আসেন নোয়াখালীর রফিকুল ইসলাম। পাহাড় কেটে তিন কক্ষের ঘর নির্মাণ করে বসত গড়ে তোলেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতে ধসের সময় সেই পাহাড়ের একটি অংশ রফিকুলের ঘরে পড়ে। এতে তার স্ত্রী-ছেলে, বোন ও বোনের দুই মেয়ে নিহত হন। তবে রফিকুল ইসলাম, ভাই গিয়াস উদ্দিন ও দুই মেয়ে জান্নাত ও সালমা পাহাড়ধসের পর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। বেঁচে যাওয়া চারজনই সুস্থ রয়েছেন।
পাহাড়ধসের পর ঘর থেকে বের হয়ে যান রফিকুল ইসলাম। তিনি আশপাশের লোকজনকে ডাকাডাকি করেন। তার ভাই গিয়াস উদ্দিনও ঘটনার পর নিজে নিজে বের হয়ে যান। এর মধ্যে ছোট মেয়ে সালমা বের হয়ে পাশের একটি ঘরে গিয়ে কাঁদতে থাকে। তখন প্রতিবেশী আরিফুল ইসলাম গিয়ে জান্নাতকে টিনের নিচ থেকে বের করে আনে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ করে পাহাড় ঘরের ওপর এসে পড়ে। আমি দৌড়ে বের গেলাম। পরে আশপাশের সবাইকে ডাকাডাকি করে আনলাম। সকাল ৮টার দিকে মাটি খুঁড়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ বের করা হয়।’
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, লটকন শাহ মাজার এলাকার তিন নম্বর সমাজের একটি পাহাড়ের মাঝামাঝিতে পেটের অংশে টিনের ঘর করে থাকতেন রফিকুল ইসলাম। পাহাড়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। এর মধ্যে খাড়া ঢালে টিনের ঘর বানানো হয়েছিল। পাহাড়ধসে ঢাল দিয়ে নামা মাটি সরাসরি ঘরের ওপর পড়েছে। ওই ঘরে উঠতে আরেক পাহাড় থেকে অন্তত ৪০ ফুট উঁচুতে উঠতে হয়। বালুর বস্তা দিয়ে ঘরে ওঠার জন্য প্রায় ৪০ ফুট সিঁড়ি করেছিলেন। ওই ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও আশপাশের বিভিন্ন ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে।
ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা ছিন্নমূল মানুষ। সরকারি এসব পাহাড়ে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার আছে। এখানে রাস্তাঘাট-স্কুল সব আমরা করেছি। এখানে ১২০টি পরিবার পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছে। রফিকের ঘরটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই তাকে সরে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে যায়নি।’
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, জঙ্গল ছলিমপুরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের বাইরের। ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, বরগুনা, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসব লোক ছিন্নমূলের নামে সরকারি এই খাসজমি দখল করেছে। এখানকার পাহাড়গুলো অপরাধীদের অভয়ারণ্য বলেও অভিযোগ আছে। অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই জঙ্গল ছলিমপুরে আসা-যাওয়া করেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। বিভিন্ন সময় সেখান থেকে গ্রেফতার হয়েছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, উদ্ধার হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যের বিপুল আধার। কিন্তু গত কয়েক দশকে পাহাড়ের পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। তাতে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে পাহাড়। যদিওবা পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তার ওপর এ দেশের পাহাড়গুলো পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। তবে মানুষের অপরিণামদর্শী ও অজ্ঞতপ্রসূত কর্মকান্ড এখানে পাহাড়ধস ত্বরান্বিত করেছে। একটি সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে মানবিক বিপর্যয়কর দুর্যোগে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গত বুধবার রাত থেকে সীতাকুন্ডে চলছিল ভারী বর্ষণ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৩৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল, যা ১১ জুন রাঙামাটির রেকর্ডের চেয়েও বেশি। ওইদিন রাঙামাটিতে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়; রাঙামাটিসহ চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাহাড়ে ভূমিধসের ঘটনা এই বছরই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে কেবল চট্টগ্রামেই পাহাড়ধসে ১২৭ জন মারা গিয়েছিল। এরপর ২০১৬ ছাড়া প্রতি বছরই কমবেশি মানুষ মারা গেছে। এর বাইরে কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ধসে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, জঙ্গল ছলিমপুরে কিভাবে বসতি গড়ে উঠেছে, তা সবই আপনারা জানেন। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসও বন্ধ করা সম্ভব হবে না। পাহাড়ে উচ্ছেদ করতে বিভিন্ন পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণদের উচ্ছেদের পর যাচাই-বাছাই করে পুনর্বাসন করার চিন্তাভাবনা চলছে।
"