হাসান শান্তনু

  ২৯ মে, ২০১৭

বাজেট ভাবনা : শিক্ষা

শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে

চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ না থাকায় শিক্ষা খাতের কয়েকটি প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ইউনেসকো ঘোষণার অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে মোট বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখছে না সরকার। শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর সরকারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য এ খাতের বাজেট এখনো অপ্রতুল বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরস্পরকে দুষছেন। বরাদ্দ কম হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা দায়ী করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়কে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের দাবি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাহিদার চেয়েও বেশি বরাদ্দ পায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক্কলিত বরাদ্দ চায় ২৬ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয় ২৬ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। তবে দুই মন্ত্রণালয় পর্যায়ের তর্ক বাদ দিয়ে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনেসকো ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জোরালো দাবি বিশেষজ্ঞদের। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরিসহ শিক্ষার সব স্তরে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘ধনী ও অনুৎপাদনশীল খাত থেকে কর আদায় করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। শিক্ষা খাতে বাজেট না বাড়ালে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। পৃথিবীর অনেক অনুন্নত দেশও শিক্ষা খাতে আমাদের চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা দরকার।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘শিক্ষা খাতে অর্থ বাড়ানোর পাশাপাশি এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। দিন দিন জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এসব খাতে ব্যয় বাড়ানো কতটা প্রয়োজন তা ভেবে দেখতে হবে।’

তথ্য মতে, মহাজোট সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ৩ শতাংশ কমে। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমে মোট জাতীয় আয়ের (জিডিপির) ০.১৬ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে গুণগত মান উন্নয়ন ও ক্রম উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে সরকার গঠন করে। তবে চলমান অর্থবছরে টাকার পাশাপাশি শতাংশের হিসাবেও বরাদ্দ বাড়ে। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি। বরাদ্দ বাড়ানোকে ইতিবাচক বললেও যথেষ্ট হয়নি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। এতে এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ। শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রশংসার দাবিবার। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও উল্লেখ্য, ইউনেসকো ঘোষণার অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে একটি দেশের প্রকৃত টেকসই উন্নয়নের জন্য বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ এবং জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত।’

তথ্য মতে, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি বর্তমানের চেয়ে পাঁচ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হবে। গত ৩১ মার্চ বাজেট-সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ তথ্য জানান। আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪১৫ লাখ কোটি টাকা হতে পারে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টিউশন ফি মাত্র ১২ থেকে ১৬ টাকা। এটি অবাস্তব। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়াশোনার খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুব সামান্য। এ জন্য আগামী বাজেটে টিউশন ফি পাঁচ গুণ বাড়বে। বেতন ও টিউশন ফিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর শিক্ষা খাতে নতুন শঙ্কা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রয়োজনে অন্য খাতে ভর্তুকি দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি বাড়ানো উচিত হবে না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার জন্য চলতি অর্থবছরে ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। চাহিদার তুলনায় এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ কম ছিল বলে অনেকে এখনো টাকা পাননি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে সব শিক্ষক তাদের সুবিধা পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫১ হাজার ৮৭৪ জন বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীকে ২ হাজার ৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা অবসর ভাতা দেওয়া হয়।’

শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘এডুকেশন ফর অল’র (ইএফএ) উদ্যোগে গত বছর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন মতে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। জিডিপির বরাদ্দের দিক দিয়ে ১৬১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী একটি দেশকে শিক্ষা খাতে জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ আর জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হয়। উন্নত দেশগুলো শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এমনকি আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত কেনিয়া জাতীয় বাজেটের ৩১ শতাংশ ও সেনেগাল ৪০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ সার্বিক শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। প্রতিবেশী ভারতে এটি ছিল ৩ দশমিক ২ শতংশ। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় ছিল যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৩ শতাংশ করে।

জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা আর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ২ দশমিক ১১ শতাংশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist