প্রতীক ইজাজ

  ২৮ মে, ২০১৭

রোজার আগের দিনই দাম বাড়ল নিত্যপণ্যের

বাজার নিয়ন্ত্রণে এবারও ব্যর্থ প্রশাসন

এবার রোজায়ও সাধারণ মানুষের জন্য কোনো স্বস্তির খবর নেই। রোজা শুরুর আগের দিনই অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বাজার। তরিতরকারি ও শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ, মাংসের দাম আরো বেড়েছে। ইতোমধ্যেই বেঁধে দেওয়া দামের বাইরে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে মাংস। পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও বেড়ে গেছে রোজার প্রয়োজনীয় পণ্য চিনি, ডাল, ছোলা, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। ফলে প্রতিবারের মতো এবারও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে রোজা শুরুর এক দিন আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন পণ্যের দাম।

রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে এক মাস ধরেই নানা টালবাহানা করছিলেন আমদানিকারক, পাইকারিসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়াতে এ মাসের শুরুতেই ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখান আমদানিকারকরা। তারা বলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল না হলে আমদানীকৃত পণ্যে ৬ শতাংশ মূল্য বেশি গুনতে হবে। সে ক্ষেত্রে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর দামও বেড়ে যাবে। এমনকি এসব কথা বলে তখনই কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়ে এলেও দাম তো কমেইনি, উলটো এখন রোজার শুরুতেই আরো এক দফা দাম বাড়ল।

অথচ রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল হবে বলে এ মাসের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্যের মজুদ আছে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এবার টিসিবি সম্পূর্ণ তৈরি আছে। সরকার ডাল ও ছোলা অস্ট্রেলিয়া থেকে এনেছে। এমনকি দেশে পণ্যের মজুদ, বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের স্থিতিশীলতা ও ভোজ্য তেলের দাম কমায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতাও বলছে, পণ্যের মূল্য নিয়ে অরাজকতা তৈরির সুযোগ নেই।

এমনকি বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কম মূল্যে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে ১৫ মে থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। তা ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুই সিটি করপোরেশনও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে এরই মধ্যে মাংসের দাম নির্ধারণ করেছে সিটি করপোরেশন। প্রতিটি বাজারে পণ্যের তালিকা টানানোরও উদ্যোগ রয়েছে। রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বাজারে পরিদর্শক দল পাঠানেরও উদ্যোগ রয়েছে।

কিন্তু এসব আশ্বাস ও উদ্যোগের সঙ্গে মাঠের চিত্রের কোনো মিল না পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বাজার। ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করতে ঠিকই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে এবারও রোজার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো প্রশাসন। অবশ্য অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা এই মুহূর্তেও বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মত দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর অধ্যাপক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ডলারের দাম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। মুদ্রার বিশ্ববাজারও স্থিতিশীল। বেশ কিছু পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। সুতরাং অতিরিক্ত মুনাফা করতে না চাইলে এসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ রোজার পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকায় রোজার বাজারে অরাজকতার সৃষ্টির সুযোগ নেই। অবশ্যই সরকারকে কঠোর হতে হবে। মজুদদারি ঠেকাতে রমজানের আগেই বাজার মনিটরিং করা উচিত ছিল। সেটি যখন হয়নি, এখন আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। সর্বশেষ গতকাল ও গত এক সপ্তাহের বাজার পর্যালোচনা করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য গতকাল রোজার আগে নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করলে সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। এ সময় তিনি জানান, যেখানেই অনিয়ম হবে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বছর রমজানে ডিএসসিসির ২৯টি কাঁচাবাজারে করপোরেশনের আটটি মনিটরিং টিম থাকবে। এদের নেতৃত্ব দেবেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তারা পুরো রমজান বাজার মনিটরিং করবেন।

কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা চোখে পড়েনি। এমনকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমদানিকারকসহ বড় ব্যবসায়ীদের কোনো নির্দেশ দিতেও শোনা যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, বাজারে সরকারের মনিটরিং না থাকায় সুবিধাভোগী অসৎ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটছেন। আমদানিকারক, মিলমালিক, পাইকার ও খুচরাপর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

আজ থেকে শুরু হলো মুসলমানদের রোজা শুরু। এ মাসে পণ্যের দাম কিছুটা কম রাখার ধর্মীয় বিধান থাকলেও উলটো ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে দেন।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেগুন, শসা, টমেটো, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন সবজির দাম বেড়েছে বেশি। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে গতকাল শসার দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ৩০-৪০ টাকার টমেটো প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে বেগুনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। গাজরের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। প্রতি হালি লেবু, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, বাঁধাকপি, করলা, কাঁকরোল, ধুন্দল, মুলা, কাঁচকলা, কাঁচা পেঁপে, কচুসহ সাধারণ সবজির আগের তুলনায় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বেড়েছে মাছের দামও। প্রতি কেজি রুই ও কাতল মাছ ২০-৪০ টাকা বেড়ে ৩০০-৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঙ্গাস ১২০-১৫০ টাকা, কই ২৪০-৩০০ টাকা, টেংরা ৪০০-৬০০ টাকা ও শিং ৪৪০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও রোজায় খুবই প্রয়োজনীয় পণ্য চিনি, ডাল, ছোলা, ভোজ্য তেল, চাল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৫-১৬ লাখ টন। রোজায় চিনির প্রয়োজন হয় আড়াই লাখ টনের মতো। দেশে বর্তমানে চার লাখ টনের মতো চিনির মজুদ রয়েছে। অথচ রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭৩-৭৫ টাকায়। এক কেজির কম বেচাকেনায় বিক্রেতারা কেজিতে রাখছেন ৮০ টাকা পর্যন্ত। আগের সপ্তাহে পণ্যটি ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। আর মাসখানেক আগে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৬০ টাকা। একইভাবে সরকারি হিসাবে দেশে বছরে ছোলার চাহিদা ৫-৬ লাখ টন। রোজায় চাহিদা আড়াই-তিন লাখ টন। মজুদ আছে তিন লাখ টনেরও বেশি। অথচ সেই ছোলার দামও বেড়েছে। ১৫ দিন আগের কেজিপ্রতি ৭০-৭৫ টাকার পণ্যটি গতকাল বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। এক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৪৬ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে ৫২ টাকা হয়েছে। আমদানি খরচ, পরিবহন ও ব্যবসায়ীদের মুনাফাসহ প্রতি কেজি ৭০ টাকা বিক্রি করলেই চলে। কিন্তু বাড়তি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা এর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল সাড়ে আট টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় নয় টাকা। দেশে এক মাস আগে খুচরা বাজারে প্রতি কেজির দাম ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। ভালো মানের পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। মাঝারি মানের ৩৮ এবং একটু ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে।

এক মাস আগে দেশের বাজারে প্রতি কেজি রসুনের দাম ছিল ২১০-২৩০ টাকা। নি¤œমানের রসুন ছিল ১৫০ টাকা কেজি। বর্তমানে নিম্নমানের রসুন ২৩০ টাকায়, ভালো মানের রসুন ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে প্রতি কেজি আদার দাম ছিল ৬০-৯০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ছিল ৮২ থেকে ৮৬ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১০৫ টাকা কেজি দরে। এক মাস আগে নিম্নমানের মসুর ডালের কেজি ছিল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। খুব ভালো মানের ডালের কেজি ছিল ১৩৫ টাকা। বর্তমানে নিম্নমানের মসুর ডালের কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা। মাঝারি মানের ডাল ১২০ টাকা এবং ভালো মানের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়।

গতকাল শনিবার রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আগের সপ্তাহে দাম ছিল ১৫০ টাকা কেজি। সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ টাকা পর্যন্ত। ১৬৫ টাকা থেকে বেড়ে লাল লেয়ার বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকায়। ২০ টাকা বেড়ে সাদা লেয়ার বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। দেশি মুরগির দামও আকারভেদে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

রোজায় মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। প্রতি কেজি দেশি গরুর মাংস ৪৭৫ টাকা, ভারতীয় গরুর মাংস ৪৪০ টাকা, মহিষের মাংস ৪৪০ টাকা, খাসির মাংস ৭২৫ টাকা এবং ভেড়া ও ছাগলের মাংস ৬২০ টাকা। কিন্তু সে নির্দেশ মানছে না মাংস ব্যবসায়ীরা। গতকাল গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে। খাসির মাংসের দাম রাখা হয়েছে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist