প্রতীক ইজাজ

  ২৫ মে, ২০১৭

নির্বাচনী রোডম্যাপ

সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কতটুকু সক্ষম ইসি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। তবে ঘোষণার এক দিনের মধ্যেই সে রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। রোডম্যাপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি রোডম্যাপকে গুরুত্ব না দিয়ে তার আগে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়টি ফয়সালার দাবি তুলেছে। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ দিতে বলছে ইসিকে। একই সঙ্গে রোডম্যাপে ইসির আগাম নির্বাচনের ভাবনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে, ইসির রোডম্যাপে আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিত সঠিক নয়। নির্বাচন যথাসময়ে সাংবিধানিকভাবে অনুষ্ঠিত হবে।

ইসির ঘোষিত রোডম্যাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, এই রোডম্যাপ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত বহন করে। একই সঙ্গে তারা বিএনপির নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়টি ‘রাজনৈতিক, ইসির অন্তর্ভুক্ত নয়’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই ফয়সালা করতে হবে।

বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, এই রোডম্যাপ অনুযায়ী ইসি কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে, সেটি নির্ভর করছে নির্বাচনে রাজনৈতিক ও সরকারের চাপ থাকবে কি না; আর থাকলেও তা কতটুকু ও কিভাবে উতরাতে পারবে ইসি, সেটার ওপর।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন দেখে হতাশ ছিলাম। নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু নানা সমালোচনার পরও অনেক সময় ভালো কাজ করে। তবে এখন পর্যন্ত এই কমিশনের কোনো বিতর্কিত বা সমালোচিত কর্মকান্ড দেখিনি। তবে তাদের ওপর নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সরকারের চাপ কতটুকু থাকে ও তা কিভাবে উতরাতে পারবে; সেটার ওপর নির্ভর করছে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিভাবে কাজে লাগায়, কিভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেটার ওপরও নির্ভর করছে।

গত মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা খসড়া রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। রোডম্যাপে নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে। অর্থ ও পেশিশক্তির অবৈধ ব্যবহারমুক্ত এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে আইনি কাঠামোগুলো সংস্কার করা হবে। সেজন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের মতামত নেওয়া হবে। এমনকি রাজনৈতিক দল না চাইলে ইসি ইভিএমে যাবে না বলেও উল্লেখ করেছে।

ঘোষিত রোডম্যাপে আগাম নির্বাচন ও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। শুরুতেই ইসির আগাম নির্বাচনের ভাবনা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, নির্বাচন যথাসময়ে সাংবিধানিকভাবে অনুষ্ঠিত হবে। রোডম্যাপ ঘোষণার এক দিন আগেই ইসিকে নির্বাচনে কাগুজে ব্যালটের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে দলের আপত্তির কথা চিঠি দিয়ে জানায় বিএনপি। ইসিও ইভিএমের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ওপর ছেড়ে দেয়। রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো আপত্তি না জানালেও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়টি ফয়সালার কথা বলে রোডম্যাপ এড়িয়ে গেছে। তবে নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক বলে বিএনপির দাবি অমূলক বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

এমন পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বর্তমান ইসি কতটুকু সক্ষম কিংবা তাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলোইবা কি-এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। অতিমাত্রার রাজনৈতিক চাপ ও সরকারের হস্তক্ষেপ ইসির নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে বড় বাধা বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, সর্বশেষ রকিবউদ্দিন কমিশনের ব্যর্থতা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে খাদে ফেলে দিয়েছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জন-অনাস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষের প্রশ্ন, তারা ভোট দিতে পারবেন কি না। বর্তমান কমিশনের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন নিয়ে মানুষের এই ধারণা পাল্টানো। মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, আস্থা অর্জন করা। তবে শুধু ইসির সদিচ্ছা দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, এজন্য নির্বাচনকালীন সরকারের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি মতৈক্য জরুরি বলেও মত দেন তারা।

তবে বর্তমান ইসি সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সক্ষম বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, সাবেক ড. হুদা কমিশন রোডম্যাপ দিয়েছিল। বর্তমান কমিশন সেই রোডম্যাপকে শানিত ও বিস্তৃত করে এনেছে। বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ইভিএম নিয়ে। এই নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু ইসি এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে কৌশলে বের হয়ে এসেছে। তবে বড় কাজ নির্বাচন করা। ইসিকে খোলামন নিয়ে এগোতে হবে। সব দলের আস্থা অর্জন করতে হবে।

‘অবশ্য ইসি এরই মধ্যে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে’-উল্লেখ করে এই নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, বাঘাইছড়ির মতো দুর্গম এলাকার নির্বাচনে ইসি কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকেছেন। তারা দায়িত্ব গ্রহণের পর যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এখন পর্যন্ত সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছেন। ভিন্ন ধরনের ধারা তৈরি করতে চান তারা। আশা করছি, এই কমিশন এমন নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, যে আগামীর জন্য তারা দৃষ্টান্ত তৈরি করবেন।

কিন্তু রাজনৈতিক চাপ যদি থাকে-এমন প্রশ্নের উত্তরে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, সরকার বা রাজনৈতিক চাপ সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা এই কমিশনের আছে। কমিশনে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ও যোগ্য কর্মকর্তারা রয়েছেন। এখন পর্যন্ত এই কমিশনের নেতিবাচক কিছু দেখছি না। সুতরাং তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ-সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।

তবে বিশ্লেষকরা এমনও বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছাই একমাত্র বিষয় নয়। নির্বাচনকালীন সরকারের কতটুকু সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকে তার ওপরও নিরপেক্ষ নির্বাচন নির্ভর করে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, বিদায়ী রকিবউদ্দিন কমিশনের পাঁচ বছরের মেয়াদে প্রশংসার পাশাপাশি মিলেছে দুর্নামও। প্রথম দুই বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রশংসা পেলেও শেষের তিন বছর ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়ে বিদায়ী কমিশন। বিশেষ করে কমিশনের সময়ে অনুষ্ঠিত প্রায় সবগুলো নির্বাচনেই নির্লজ্জ দলীয়করণ, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা শেষ পর্যন্ত ‘বিতর্কিত ও ব্যর্থ’ কমিশন হিসেবে আখ্যা পায়। এমনকি বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। রকিব কমিশন ২০১৩ সালে আরপিও থেকে এই ধারাটি বাদ দিয়ে কমিশনকে ক্ষমতাশূন্য করার উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে গণমাধ্যমের সমালোচনার মুখে এবং আইন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ধারাটি বহাল থাকে। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনে কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের। কিন্তু কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনকে সংবিধানের এই চেতনাকে উল্টোরথে চাপিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রার্থীরা অভিযোগ করলে কমিশন থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই। সব ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তার।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সময় থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী এবং সক্ষম করার কথা বলে আসছে। কিন্তু কমিশনকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ কারো পক্ষ থেকেই নেওয়া হয়নি। বরং কমিশন নিজে এবং সরকারও নানা সময়ে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করারই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সুতরাং এই অবস্থা থেকে বেরোতে না পারলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

গত কমিশনের ব্যর্থতা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে খাদে ফেলে দিয়েছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর জন-অনাস্থা তৈরি হয়েছে। বর্তমান কমিশন বিতর্কমুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের সহায়তা ও সদাচরণ নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি মতৈক্য জরুরি।

বিশ্লেষকদের মতে, ‘ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়ে আমাদের কমিশনের ক্ষমতা বেশি। তাদের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। আমাদের কমিশন বিধি প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু তাদের কমিশন নিরপেক্ষ। আমাদেরটা দলীয় মোড়কে আবৃত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতিকরণ। সরকারি দলের চাপ। এই রাজনীতিকরণই এখন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist