নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ মে, ২০১৭

রেইনট্রিতে মদ ও শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে

*বনানীর ওসিসহ তিন পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ *আপন জুয়েলার্স মালিকের কোটি টাকার গাড়ি জব্দ

রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে মদ রাখা এবং ভ্যাট-শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)। একই সংস্থা শুল্ক ফাঁকির দায়ে সিলেটের জিন্দাবাজারে অভিযান চালিয়ে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের দেড় কোটি টাকা দামের একটি মার্সিডিজ গাড়ি জব্দ করেছে। অন্যদিকে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার রেইনট্রির মালিক, ব্যবস্থাপক এবং গুলশান জোনের উপকমিশনার ও বনানী থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি। আর ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর মামলা নিতে বিলম্ব, থানায় তাদের সঙ্গে অসদাচরণ ও সঠিক তদারকি না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বনানী থানার ওসি ফরমান আলীসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশের তদন্ত কমিটি।

সিআইআইডির মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, রেইনট্রি হোটেলে মদের কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু সেখান থেকে ১০ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দারা। সেই মদ হোটেলে কীভাবে ঢুকেছে, সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। রেইনট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান হারুন মদের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে শুল্ক গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এদিকে রেইনট্রি হোটেল থেকে জব্দ করা ১০ বোতল মদ ধর্ষণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন সিআইআইডি মহাপরিচালক। তিনি বলেছেন, রেইনট্রি হোটেল থেকে যে ১০ বোতল মদ উদ্ধার করা হয়েছে তা বনানীর দুই তরুণী ধর্ষণ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। যেহেতু ধর্ষণের ঘটনায় মদের ব্যবহার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, সেহেতু এটি মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত। তাই আমরা এ মদ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করব। আশা করছি, এটি মামলার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তিনি আরো বলেছেন, ‘রেইনট্রি থেকে মদ উদ্ধারের পর হোটেল কর্তৃপক্ষ কিন্তু দাবি করেছিল এটা মদ নয়, জুস। তবে আজকের (মঙ্গলবার) জিজ্ঞাসাবাদে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা স্বীকার করেছে যে এগুলো মদ। তবে তারা এগুলোর কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।’

হোটেলটির এমডি আদনান হারুনের বরাত দিয়ে ড. মঈনুল খান আরো বলেছেন, মালিকপক্ষ এই মদের বোতলের বিষয়ে কিছুই জানত না বলে দাবি করেছেন আদনান হারুন। তবে জেনারেল ম্যানেজার ফ্যাঙ্ক হেনরি ফোরজেন এবং ফুড কন্ট্রোলার এমদাদুল আমিন দাবি করেছেন, এপ্রিলের ৩০ তারিখের দিকে হোটেলে বেশ কয়েকজন চায়নিজ গেস্ট এসেছিলেন। এই মদগুলো তারাই সেখানে রেখে গেছেন। পরে হোটেলের লোকজন এগুলো উদ্ধার করে ১০১ নম্বর রুমে নিয়ে রাখে। অবৈধ মদ উদ্ধারের বিষয়ে থানায় জিডি অথবা অন্য কোথাও নথিভুক্ত করা হয়েছিল কি না-জানতে চাইলে এ বিষয়ে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

সিআইআইডি মহাপরিচালক আরো বলেছেন, তিনি আরো বলেছেন, যেহেতু এই মদগুলো বিদেশ থেকে আনা, কর ফাঁকি দিয়ে আনা হয়েছে সেহেতু শুল্ক ফাঁকি আইনে মামলা করা হবে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য আইনে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ থাকবে। ভ্যাট ফাঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তারা প্রায় আট লাখ ২৭ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন। তারা এই ভ্যাট কাস্টমারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এ বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থার সুপারিশ করব।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হন রেইনট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মোহাম্মদ আদনান হারুন। এ সময় তার সঙ্গে চাচা মজিবুল হক কামাল, ফুপা আকবর হোসেন মঞ্জু, চাচাতো ভাই হাসিব রুমি এবং আইনজীবী জাহাঙ্গীর কবির ছিলেন। এরপর দুপুর ১২টা থেকে অধিদফতরের যুগ্ম পরিচালক শফিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল আদনান হারুনসহ চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর আগে গত ১৭ মে উপস্থিত হয়ে হোটেলে মদ রাখার ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা ছিল আদনান হারুনের। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সেদিন তিনি হাজির হননি। এ সময় তার আইনজীবী জাহাঙ্গীর কবির অধিফতরে হাজির হয়ে এক মাসের সময় চেয়ে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ মে সশরীরে অধিদফতরে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়।

আপন জুয়েলার্সের মালিকের গাড়ি জব্দ : আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের একটি মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের গাড়ি জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর (সিআইআইডি)। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সিলেটের জিন্দাবাজারে অভিযান চালিয়ে থেকে গাড়িটি জব্দ করা হয়। এ বিষয়ে সিআইআইডির মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান জানান, অস্বচ্ছ অর্থের উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে প্রথমে শুল্ক ফাঁকি ধরা পড়ে। এরপর দেখা যায়, গাড়িটির ম্যানুফ্যাকচার ২০১১ সালের, কিন্তু ২০০২ সালের দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা। তাই গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। গাড়ির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা।

মালিকের ছেলের অপকর্মের সূত্র ধরে এখন আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ-ডায়মন্ডের উৎস বৈধ কি না, তার খোঁজে জোরালোভাবে মাঠে নামে সিআইআইডি। এর আগে ধর্ষণের ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদের মালিকানাধীন আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি বিক্রয়কেন্দ্রে একযোগে অভিযান শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দারা।

বনানীর ওসিসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ : বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর মামলা নিতে বিলম্ব, থানায় তাদের সঙ্গে অসদাচরণ ও সঠিক তদারকি না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বনানী থানার ওসি ফরমান আলীসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। অভিযুক্ত অপর দুই কর্মকর্তা হলেন, বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন ও গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার। গত সোমবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ডিএমপি কমিশনারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। মোট ৭৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের ৭৪ পৃষ্ঠায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।

গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে সাফাতের জš§দিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন দুই তরুণী। নানা হুমকি-ধমকির একপর্যায়ে ঘটনার ৪০ দিন পর গত ৬ মে বনানী থানায় সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণীদের একজন। এরপর গত ১১ মে রাতে মামলার প্রধান অভিযুক্ত আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ এবং তিন নম্বর আসামি র‌্যাগনাম গ্রুপ ও পিকাসো রেস্টুরেন্টের মালিকের ছেলে সাদমান সাকিফকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ সদর দফতর। এরপর রিমান্ড শেষে গত ১৮ মে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এরপর গত ১৫ মে রাতে পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডের ইব্রাহীম হোটেল থেকে সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। একই দিন গুলশান থেকে মামলার অপর আসামি সাফাতের দেহরক্ষী রহমত ওরফে আবুল কালাম আজাদকেও গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এরপর গত ১৭ মে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থেকে মামলার দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে আবদুল হালিমকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিই এখন পুলিশের হেফাজতে। হালিম সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। গত ২১ মে সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ নিয়ে তিন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। নাঈম ওরফে হালিম ছাড়া সবাইকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist