নিজস্ব প্রতিবেদক ও কুমিল্লা প্রতিনিধি

  ২৯ মার্চ, ২০১৭

ভোটের পরিবেশ নিয়ে তবু শঙ্কা

৪৩ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ, দাবি বিএনপির। আওয়ামী লীগের মতে, এ সংখ্যা ৩৭

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে (কুসিক) আলোচিত যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে আগামীকাল, স্থানীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে তার উত্তাপ বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান জাতীয় রাজনীতিতেও। কুমিল্লা শুধু নয়, এই নির্বাচন জাতীয়ভাবেও যেন পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মর্যাদার লড়াইয়ে। এই সিটিকে নিজেদের কাছেই রেখে দিতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। একই মনোভাব বিএনপিরও। এখানে জয় অব্যাহত রেখে বিএনপি প্রমাণ করতে চায়, সরকার মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এদিকে, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনী প্রচারণা চললেও ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কুমিল্লা শহরের ভোটাররা।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে শেষ হয়েছে এই নির্বাচনের প্রচার কাজ। এখন রাত পোহালেই ভোট। ভোটের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসি ও স্থানীয় প্রশাসন। কুমিল্লায় পৌঁছে গেছে ব্যালটপেপার ও ভোটবাক্সসহ নির্বাচনী সরঞ্জাম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে তৎপর পুলিশ। মোতায়েন আছে বিজিবি। স্থানীয় ভোটাররা এখন তাদের রায় দেওয়ার অপেক্ষায়। এবারের কুমিল্লা বাড়তি মনোযোগ কেড়েছে এই কারণে যে, এটাই দলীয় প্রতীকে দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচন।

নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকলেও কুমিল্লার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি থাকায় ভোটের দিন পরিবেশ কেমন থাকে তা নিয়ে আশঙ্কা আছে জনমনে। শহরের ২৭ ওয়ার্ডে ১০৩টি কেন্দ্র রয়েছে। বিএনপি বলেছে ৪৩ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। আওয়ামী লীগের মতে, এই সংখ্যা ৩৭।

নগরবাসীর অনেকে বলেছেন, এবারের নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এর মধ্যে কুমিল্লা উত্তরের চেয়ে বেশি শঙ্কা দক্ষিণের ভোটকেন্দ্রগুলো নিয়ে। কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডের সংখ্যা ২৭। ভোটকেন্দ্র ১০৩টি। এর মধ্যে গত সোমবার নগরের বাদুড়তলা এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি ৪৩টি কেন্দ্রকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করেছে। ওই কেন্দ্রগুলোতে উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে বলেছে দলটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ৩৭টি কেন্দ্রকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ চিহ্নিত করে কমিশনকে জানিয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা এ ব্যাপারে বলেন, দলগুলোর দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ নজরদারি করা হবে।

দক্ষিণের কয়েকটি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, নির্বাচন নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আছে। একাধিক ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় পরিস্থিতি আরো নাজুক পর্যায়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষের সমর্থক ভোটারদের বাড়ি-ঘরে গিয়ে নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে না যেতে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে ধানের শীষের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক কাইমুল হক রিংকু বলেন, সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আশা করি, ভোটের আগে কমিশন এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে। আর নৌকার নির্বাচন সমন্বয়কের সদস্য নুর-উর-রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। এগুলো বিএনপির অভিযোগ। তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই আগেভাগেই অভিযোগগুলো সামনে এনে পরাজয়ের কলঙ্ক মোচনের চেষ্টা মাত্র।

এদিকে, গতকাল নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বিভিন্ন এলাকা ঘুরলেও দুপুরের পর পর্যন্ত নিজ বাসস্থলে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে উঠান বৈঠকের মধ্যে তার প্রচারণা সীমাবদ্ধ রাখেন। সকালে তিনি নগরীর ১৭ নং ওয়ার্ডের তেলিকোনা ও নূরপুর এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে তিনি বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে গণসংযোগ ও সিবিএ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। দুপুরে তিনি নিজ এলাকা নগরীর ৭ নং ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর, অশোকতলা এলাকার ঘরে ঘরে ভোট চেয়েছেন। বিকেলে সীমা নগরীর ৮ নং ওয়ার্ডের ঠাকুরপাড়া এলাকায় গণসংযোগ করেন ।

এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এলাকা ছাড়ালেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুজন নেতা কাজী জাফরউল্লাহ এবং এনামুল হক শামীম সিটি নির্বাচনী এলাকার কাছাকাছি অবস্থান করছেন। দলীয় একাধিক সূত্র খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে তিনজন প্রার্থী। বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ধানের শীষ প্রতীকে লড়ছেন বিএনপিসহ ২০ দলের একক প্রার্থী হিসেবে। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার ১৪ দলের একক মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা। অপর মেয়র প্রার্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডির শিরিন আক্তার। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৪ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৪০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সবমিলিয়ে প্রার্থী সংখ্যা ১৫৭ জন।

কুসিক নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করতে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে পুরো সিটি এলাকা। ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিটিতে বিশেষ নজর রাখবে নির্বাচন কমিশন। শুধু ভোটকেন্দ্র ও ভোটারদের নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকবে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় চার হাজার সদস্য। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে প্রতি ওয়ার্ডে এক প্লাটুন হিসাবে ২৭ প্লাটুন বিজিবি সদস্য এবং প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য র‌্যাবের টহল দল মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পুলিশ, আনসার, ভিডিপি সদস্য এই নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবেন। নারায়ণগঞ্জ সিটির পর দেশের কোনো নির্বাচনে এত বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের নজির এটাই দ্বিতীয়। এ ছাড়া সব কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রতিটি কেন্দ্র পাহারায় থাকবে ২৪জন সদস্য। এসব ফোর্স আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাঠে দায়িত্ব পালন করবে।

নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সোমবার থেকে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। গোলমাল করার চেষ্টা করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মন্ডল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকবে পুরো শহরজুড়ে। কোনো ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা নেই। আশা করছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আর কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন বলেন, নির্বাচনী এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। ভোটের দিনও একই পরিবেশ বিরাজ করবে।

প্রচারণা বন্ধ: গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। সিটি নির্বাচনের বিধিমালা অনুযায়ী, ভোটগ্রহণের ৩২ ঘণ্টা আগে নির্বাচনী প্রচার বন্ধ হয়। পাশাপাশি ভোটগ্রহণের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকে।

আইনশৃঙ্খলা: গতকাল মঙ্গলবার থেকে নির্বাচনী মাঠে কাজ শুরু করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় চার হাজার সদস্য মোতায়েন হয়েছে। এর মধ্যে বিজিবি ৬০০, র‌্যাব ৩৩৮, পুলিশ এক হাজার ৬৭৮ ও আনসার এক হাজার ২৩৬ জন। বিজিবির সদস্যরা গতকাল মঙ্গলবার থেকেই টহল শুরু করেছে।

ইসির পর্যবেক্ষক: নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৭ জন ‘নীরব পর্যবেক্ষক’ হিসেবে এই সিটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন। কোথাও অনিয়মের খবর পেলে তারা কমিশনকে জানাবেন এবং সেই অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেবে ইসি।

বহিরাগত নিষিদ্ধ: নির্বাচন প্রভাবমুক্ত ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সিটির বাসিন্দা বা ভোটার নন তাদের গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতের আগে এলাকা ছাড়তে হয়েছে।

যান চলাচল: গতকাল ২৮ মার্চ মধ্যরাত থেকে ৩১ মার্চ সকাল ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া ভোটগ্রহণের আগে অর্থাৎ আজ ২৯ মার্চ মধ্যরাত থেকে ৩০ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত লঞ্চ, স্পিড বোট, ট্যাক্সি ক্যাব, বেবিটেক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক ও টেম্পুর চলাচলের ওপরও এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইসি।

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা: প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার এক হাজার ৯৮৭জন। এর মধ্যে প্রিসাইডিং প্রতি কেন্দ্রে একজন করে ১০৩জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার প্রতি কক্ষে একজন করে ৬২৮জন এবং পোলিং অফিসার প্রতিটি কক্ষে ২জন করে ১২৫৪জন।

ভোটার সংখ্যা: কুসিকে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ সাত হাজার ৫৬৬জন। পুরুষ এক লাখ দুই হাজার ৪৪৭জন ও নারী এক লাখ পাঁচ হাজার ১১৯জন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
কুমিল্লা সিটি নির্বাচন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist