এমএ রউফ ও মুহাজিরুল ইসলাম রাহাত, সিলেট

  ২৮ মার্চ, ২০১৭

সিলেটে কমান্ডো অভিযান

চতুর্থ দিনে নারীসহ চার জঙ্গি নিহত

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার পাঠানপাড়ায় ‘আতিয়া মহল’ নামে পাঁচতলা একটি বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী কমান্ডো অভিযানে একজন নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। দুজনের লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি লাশে সুইসাইডাল ভেস্ট থাকায় তা ঘটনাস্থলেই পড়ে আছে। বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করার পরই তা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এক আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার ফখরুল আহসান বলেন, পুরো ভবন এখন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোদের নিয়ন্ত্রণে। তবে এখনই অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হচ্ছে না। অভিযানে সেনাবাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

ফখরুল আহসান আরো জানান, অভিযানের পুরোটা সময়ই প্যারা-কমান্ডোদের অনুকূলে ছিল। ভবনজুড়ে তল্লাশি চলছে। তল্লাশি শেষ হলে ঘটনাস্থলে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে পাঠানো হবে। অভিযানের এক পর্যায়ে ভবনের ভেতরে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হলে জঙ্গিরা ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে। এ সময় জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে দুই জঙ্গি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের একজন কোমরে বাঁধা সুইসাইডাল ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটায়। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে জঙ্গিদের শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকে। তবে নিহত জঙ্গিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি সেনাবাহিনী।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে টানা ৩০ ঘণ্টা বাড়িটি ঘিরে রাখার পর গত শনিবার সকাল ৯টায় অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। গতকাল সোমবার পর্যন্ত চলে টানা চতুর্থ দিনের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গি আস্তানা এবং এর আশপাশের এলাকায়। এ সময় নারী-শিশুসহ আটকে পড়া ২৮টি পরিবারের ৭৯ জন বাসিন্দাকে ভবন থেকে উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের প্যারা-কমান্ডো বাহিনী।

প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়ন-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল কায়েস বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্র সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য। তারা সিলেটসহ সারা দেশে বড় ধরনের নাশকতার লক্ষ্যে প্রচুর গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করেছিল আস্তানায়।’

তিনি আরো জানান, ভবনের ভেতরে বেশ কিছু বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। কিছু শক্তিশালী গ্রেনেডও থাকতে পারে। এটার বিস্ফোরণ করতে গেলে পুরো ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এর আগে গত শনিবার সকাল ৯টায় ‘আতিয়া মহল’ বাড়িটি ঘিরে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এর নেতৃত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেন। প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়ন-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল কায়েস। প্রথমে সোয়াট অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পিছু হটে বলে জানান সেনা কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনী অভিযানের নাম বদলে রাখে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।

প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়ন-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল কায়েস জানান, পাঁচতলা বাড়িটিতে গত শুক্রবার ভোররাত থেকেই অভিযান চালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভেতরে আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদে বের করে আনার জন্য শনিবার সকাল ৯টায় অভিযান শুরু করা হয়। শনিবার ভবনে আটকে পড়া ৭৮ জন বাসিন্দাকে উদ্ধার করা হয়। পরদিন রোববার দুপুরে বের করে আনা হয় আটকে পড়া জ্যোৎ¯œা নামের আরেক বাসিন্দাকে। এরপর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযান শুরু হতেই মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এদিন বিকালে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায় সেনাবাহিনী। কিন্তু এতে সাড়া দেয়নি তারা। কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। শনিবার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম দফা প্রেস ব্রিফিং করা হয়। এ সময় ১৭ পদাতিক ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান জানান, আতিয়া মহলের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজার সামনে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ফেলে রেখেছিল জঙ্গিরা। সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর আতিয়া ভবনের পাশেই পাঠানপাড়ায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। ওই সময় ঘটনাস্থলেই ছাত্রলীগকর্মী ওয়াহিদুল ইসলাম অপু নিহত হন। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন। আহত হন আরো ৩৫ জন।

এদিকে, গত রোববার সকাল থেকে কয়েক দফা গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ মেলার পর বিকেলে সাংবাদিকদের সামনে আসেন সেনা সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল। ভেতরকার অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘দুইজন নিহত হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত দেখতে পেয়েছি। একজনের দেহে সুইসাইড ভেস্ট লাগানো ছিল। দুইজনকে দৌড়ানো অবস্থায় দেখে আমাদের কমান্ডোরা ফায়ার করে। তারা পড়ে যাওয়ার পর একজন সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়।’

তিনি বলেন, তাদের কাছে স্মল আর্মস আছে, ‘এক্সপ্লোসিভ আছে, আইইডি আছে। তারা ওয়েল ইকুইপড। আমরা যে গ্রেনেড ছুড়েছি, তারা সেগুলো ধরে উল্টো আমাদের দিকে নিক্ষেপ করেছে। টিয়ার শেল ছুড়লে যে আগুন জ্বালাতে হয়, তারা এসব টেকনিক জানে।’

এদিকে, গতকাল সোমবার ভোর থেকে টানা চতুর্থ দিনের মতো অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো বাহিনী। ভোর সাড়ে ৬টা থেকে ভারী গুলিবর্ষণ ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। চলে একটানা ৭টা পর্যন্ত। এরপর সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। মাঝে কিছুটা সময় কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে সকাল সোয়া ৯টার পর থেকে আবারো থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। দুপুর ২টার পর সেনা কমান্ডোরা আতিয়া মহলের দেয়াল ভেঙে ভেতওে ঢোকে। কড়া নিরাপত্তার অংশ হিসেবে আতিয়া মহলের চতুর্দিকে দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় সাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাউকে সেখানে ভিড়তে দেওয়া হয়নি।

অপারেশন টোয়াইলাইট : পুলিশ জানতে পারে, সিলেটে নব্য জেএমবির কয়েকজন জঙ্গি বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ অবস্থান করছে। পরে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির ‘আতিয়া মহল’ চিহ্নিত করে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার ভোরে আতিয়া মহলের মূল গেটে তালা দিয়ে বাসাটি ঘিরে রাখে পুলিশ। এদিন বিকালে ঢাকা থেকে আসে সোয়াট টিম, সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো বাহিনী। বৃহস্পতিবার রাতভর প্রচ- ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ভবনটি ঘেরাও করে রাখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযানটির নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। আর গত শনিবার সেনা কমান্ডোরা দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। শুরুতেই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলে ভেতর থেকে অভিযানিক দল সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। জবাবে সেনাবাহিনী গুলি চালালে তারা একের পর এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায়। পাল্টাপাল্টি গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ চলে অনেকক্ষণ। আর বিভিন্ন সময় একের পর এক প্রচ- বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। এ সময় সেনাসদস্যদের বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়। গত শনিবার সন্ধ্যায় জঙ্গি আস্তানার ৩০০ গজ অদূরে পাঠানপাড়ায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন। রাতে নগরের হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে আতিয়া মহল পর্যন্ত এক কিলোমিটার এলাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। বন্ধ করে দেওয়া হয় সড়কে যান চলাচল।

গত শনিবার অভিযানকালে আতিয়া মহলে আটকে পড়া সাধারণ বাসিন্দাদের বের করতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়ির একটি দেয়াল। পরে একে একে ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। এরপর রোববার দুপুরে জ্যোৎ¯œা (৬৫) নামের একজন বৃদ্ধাকে ভবনটির চতুর্থ তলা থেকে উদ্ধার করা হয়। তবে সেনাবাহিনীর দাবি, তিনি পার্শ্ববর্তী ভবনের বাসিন্দা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে বাড়িটি ৩০ ঘণ্টা ঘিরে রাখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাঁচতলা ভবনটিতে ৩০টি ফ্ল্যাটের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা অবস্থান করছিল বলে ধারণা করে পুলিশ। ভোর ৫টায় বাড়ির ভেতর থেকে তিন দফায় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়ে জঙ্গিরা। পরে জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে পুলিশও কয়েক দফা গুলি ছোড়ে। এর আগে শুক্র থেকে সোমবার পর্যন্ত ওই বাড়িতে থাকা জঙ্গিদের বের হওয়ার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক দফা মাইকিং করা হয়। কিন্তু ভেতর থেকে জঙ্গিরা সাড়া দেয়নি।

আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত ৬ : গত শনিবার সন্ধ্যার পর আতিয়া মহলের ৩০০ গজ অদূরে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হন। আহত হন ৪৩ জন। মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে প্রথম দফায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে পুলিশের একটি চৌকি ছিল। এরপর কর্ডন করে রাখা এলাকা ক্রাইম সিন করতে গেলে রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা বস্তাসদৃশ একটি বস্তু পরীক্ষা করার সময় দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জন নিহত হন। তারা হলেন জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম এবং আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়সর। তারা দুজনই পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্য ছিলেন। অন্যরা হলেন ছাত্রলীগকর্মী জান্নাতুল ফাহিম, ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, ডেকোরেটর ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ও খাদিম শাহ। তবে পুলিশের ভাষ্য, শহীদুল ও খাদিম আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

বোমা হামলার ঘটনায় মামলা : জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’র অদূরে বোমা বিস্ফোরণে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মোগলাবাজার থানায় এসআই শিপলু চৌধুরী বাদী হয়ে রোববার গভীর রাতে এই মামলা করেন। এতে কারো নাম উল্লেখ বা আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। মোগলাবাজার থানার ওসি খায়রুল ফজল জানান, এই মামলায় এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

গত শুক্রবার সকাল সোয়া ৭টায় সিলেটের শিববাড়ির ‘আতিয়া মহল’ নামক বাড়ি থেকে জঙ্গিরা আল্লাহু আকবার বলে উল্লাস করে বোমা ছুড়ে মারে। এরপর থেকেই পুলিশ ভবনটি ঘেরাও করে রাখে। শনিবার সকাল ৯টার সেখানে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো। টানা চার দিন পর গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পুরো ভবন প্যারা-কমান্ডোদের দখলে আসে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist