প্রতীক ইজাজ
অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি শেয়ারবাজারে
‘নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে লাগাম’
বদলে গেছে দেশের শেয়ারবাজারের সার্বিক চিত্র। কয়েক মাস ধরেই অধিকাংশ শেয়ারের দর বাড়ছে। বাড়ছে বাজার সূচকও। দৈনিক শেয়ারদর ও সূচক বৃদ্ধির চেয়েও বেড়েছে দৈনিক শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ। চলছে লেনদেনে রেকর্ড ভাঙাগড়া। গত মঙ্গলবারের পর গতকাল বুধবারও ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেনের পরিমাণ প্রতিদিনই দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এমনকি ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চালুর পর গত মঙ্গলবার প্রথম ঢাকার শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৫৭৫ পয়েন্টে ওঠে। এটিও এই সূচকের রেকর্ড অবস্থান।
এর ফলে একদিকে যেমন মানুষ এখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে শেয়ার কিনতে; তেমনি প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে। দুই পক্ষের এ প্রতিযোগিতায় দ্রুত বাড়ছে লেনদেনের গতি। সর্বত্র এখন শেয়ারবাজারের আলোচনা।
যদিও শেয়ারবাজারের এ ঊর্ধ্বগতি ও চাঙা ভাব দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক এবং কাক্সিক্ষত বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ, শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিএসইসি)। কিন্তু এ পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে সবাইকে সতর্কও থাকতে বলেছেন তারা। তাদের মতে, শেয়ারদর, সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধি যাতে লাগামহীন হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৮ জানুয়ারি ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গুজব ও ধারণার ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় ব্যক্তির নিজের। কোনো তথ্য না নিয়ে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারী সব হারিয়ে ফেলেছেন। এর জন্য সরকার ও অর্থমন্ত্রীকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু গুজবে বিনিয়োগ করে লোকসান করলে দায়ভাব নিজের। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে গতকালও দেশের দুই শেয়ারবাজারে লেনদেন গত দুই দিনের রেকর্ড অব্যাহত ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয়েছে মোট ৩২৮টি কোম্পানির ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ৩২ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। এর মধ্যে ১১৪টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দর বেড়েছে আর ১৯১টির কমেছে এবং ২৩টির দর অপরিবর্তিত আছে। টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বারাকা পাওয়ারের। একইভাবে অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) ১২১ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। লেনদেন হওয়া ২৭৮টি ইস্যুর মধ্যে দর বেড়েছে ৮৯টির, কমেছে ১৭১টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ১৮টির।
এর আগে অবশ্য প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের কারসাজির ঘটনা ঘটে। সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারই ১৫টি মামলা করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও কারসাজির নেপথ্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১০ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির পর বিগত মহাজোট সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহীম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি শেয়ারবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে তাদের শেয়ারবাজার থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেয়। একই সঙ্গে কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থারও সুপারিশ করা হয়। তবে যাদের শেয়ারবাজার থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদেরই কেউ কেউ এখন নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছেন বলে জানা গেছে। এর ফলে সম্প্রতি শেয়ারবাজারের ঊর্ধ্বগতি যেন কারসাজির পুনরাবৃত্তি না হয়, সে নিয়েও উদ্বেগে রয়েছেন সবাই। বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে শেয়ারবাজারের সার্বিক দিক সম্পর্কে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
ছয় বছর পর সর্বোচ্চ লেনদেন : দেশের শেয়ারবাজার কয়েক কার্যদিবস ধরে লেনদেনে রেকর্ড করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত মঙ্গলবার ছয় বছর পর সূচক ও লেনদেনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। সেদিন সূচকের পাশাপাশি বেড়েছে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদর। এমনকি আগের দিনের তুলনায় টাকার অঙ্কে বেড়েছে লেনদেন। দিন শেষে লেনদেন হয় ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর আগে ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৫০ কোটি ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এরপর টানা ছয় বছরেও লেনদেন ২ হাজার কোটি অতিক্রম করতে পারেনি। সেই হিসেবে লেনদেন বিগত ছয় বছরের রেকর্ড ভেঙেছে শেয়ারবাজার। একইভাবে প্রায় পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছায় সূচক। এর আগে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ডিএসইতে সূচক দাঁড়িয়েছিল ৫ হাজার ৫০২ পয়েন্টে। এরপর টানা প্রায় ৫ বছরেও সূচক ৫ হাজার ৫০২ পয়েন্ট অতিক্রম করতে পারেনি।
কয়েক মাসের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত জুন ও জুলাই মাসে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন ৩৫০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে ১০ জুলাই ২০৯ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচাও হয়। আগস্টে তা ৪৫৮ কোটি টাকায়, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে তা ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়ায়। নভেম্বরে গড়ে কেনাবেচা হয় ৬৪৩ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের কয়েকদিন হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ার কেনাবেচা হলেও এ মাসে গড়ে ৯৩৫ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এরপর মাত্র দুই সপ্তাহে লেনদেন হাজার কোটি টাকা থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কেন এই চাঙা ভাব : শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর বিনিয়োগকারীরা বাজারের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং বাজারের সূচক ও লেনদেন তলানীতে এসে ঠেকেছিল। সে সময় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়ে ওঠেন সরকারসহ শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী মহল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে মাঠে নেমে পড়েন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসি বেশকিছু উদ্যোগ নেয়। এতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাজার। সেই সুবাদে প্রতিদিনই বাড়ছে সূচক ও গড় লেনদেনের পরিমাণ। এতে প্রায় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বাজারে প্রবেশ করছেন। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ ছাড়া বাজারে স্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী করতে তৎপর রয়েছে নীতিনির্ধারণী মহল। সবমিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা বাজারে তাদের প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলছেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার বিষয় সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এ ছাড়া কিছু কোম্পানির আগাম মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগেই জেনে যাচ্ছেন মুষ্টিমেয় বিনিয়োগকারী। তারা অতিরঞ্জিত করে ওই তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন শেয়ারবাজারে। এতে করে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। তবে এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারদর বেশি দিন বাড়তি অবস্থানে থাকে না। পরে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি বাঁচানো নিয়ে সংকটে পড়তে হয়।
বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, সরকারের বিভিন্ন হস্তক্ষেপের ফলে শেয়ারবাজার এখন স্থিতিশীল রয়েছে। বাজারে আস্থা ফিরেছে। এখন বাজার তার আপন শক্তিতে চলছে। বাজারকে আরো স্থিতিশীল রাখতে দেশব্যাপী বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হবে। পাঠ্যবইয়ে শেয়ারবাজার নিয়ে রচনা থাকবে বলে জানান তিনি।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুজিব উদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্বিক বিবেচনায় পরিস্থিতি ভালো। শেয়ারবাজারের গতির দ্রুত উত্থান হলেও এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বাজার এগোচ্ছে। তাই এখনই বাজারে লাগাম টানার প্রয়োজন নেই। তবে বিনিয়োগে এখন থেকেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক হতে হবে। ২০১০ সালের মতো এখনো কিছু বন্ধ ও দুর্বল কোম্পানির উদ্যোক্তা এবং তাদের সহযোগী জুয়াড়িরা গুজব ছড়িয়ে কিছু শেয়ারের দর বাড়াচ্ছে। ভালো কোম্পানির শেয়ারদর ১০ শতাংশ না বাড়লেও এক থেকে দেড় মাসে কিছু শেয়ারের দর দ্বিগুণ হয়েছে। প্রয়োজন হলে এসব শেয়ারের দরে লাগাম টানতে হবে। ৩০ পিইর ওপরে থাকা কোম্পানির শেয়ার কেনায় বিনিয়োগকারীকে মার্জিন ঋণ প্রদান বন্ধ করার চিন্তা করার জন্য বিএসইসিকে পরামর্শ দেন তিনি।
সতর্ক থাকার পরামর্শ : শেয়ারবাজারের এই ঊর্ধ্বগতি বিনিয়োগকারীদের কতটুকু আশ্বস্ত করতে পারবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি বাজারে একটানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করছেন তারা। এ জন্য তারা সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে
অর্থনীতিবিদ মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজার অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণে বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা মুনাফা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাওয়ায় অনেকে বাজারমুখী হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মুনাফা দেবে এমনটা আশা করা কঠিন। কারণ দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে তেমন উন্নতি হয়নি। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ভালো ফলাফল করতে না পারায় বছর শেষে ভালো মুনাফার আশা করাটা খুব বেশি যৌক্তিক হবে না। ব্যবসা বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অনেক অলস অর্থ শেয়ারবাজারে প্রবেশ করেছে। অবমূল্যায়িত শেয়ার থেকে মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রত্যাশায় অনেক নতুন করে বাজারমুখী হয়েছেন। এসব কারণে দৈনিক লেনদেন বাড়ছে। তিনি বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ারগুলোর যাতে অতিমূল্যায়িত না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিতে বলেন।
অপর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, মূল্য সংশোধন না হলে দৈনিক লেনদেনে ক্রমাগত উন্নতি অবশ্যই চিন্তার কারণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যাওয়ায় বাজারে কিছু অলস অর্থ প্রবেশ করছে। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন কওে শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছেন। তিনি বিনিয়োগের আগে সাবধানতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি গুজবে কান না দেওয়া এবং ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন।
পিডিএসও/মুস্তাফিজ
"