নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৬ জুলাই, ২০২০

বোরকা পরেও শেষ রক্ষা হলো না সাহেদের!

চুলে কলপ, গোঁফও ফেলে দেন

চুলে কলপ, গোঁফ ফেলে দিয়ে বোরকা পরেও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। র‌্যাব বলছে, গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন সাহেদ। করোনা পরীক্ষায় রিজেন্ট হাসপাতালের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির খবর ফাঁসের পর পালিয়ে যাওয়া সাহেদ এক সপ্তাহ পর গতকাল বুধবার ভোরে সাতক্ষীরার দেবহাটা সীমান্তে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টায় ছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে র‌্যাব। ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা কাজ হাসিল করে নেওয়া সাহেদের কাছে ‘অনেক তথ্য’ পাওয়ার কথাও জানিয়েছে র‌্যাব। সাতক্ষীরায় গ্রেফতারের পর হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনার পর সাহেদকে নিয়ে উত্তরায় তার আরেকটি কার্যালয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব।

এরপর বিকালে উত্তরার র‌্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের এই অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতে উপস্থিত হন খোদ র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, সাহেদ অনেক কিছু বলেন, তবে তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাবে না। পলাতক অবস্থায় সাহেদ কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির আশ্রয়ে ছিলেন কিনা সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মহাপরিচালক বলেন, তার সঙ্গে কথা বললে আরো বিস্তারিত জানা যাবে। সাহেদ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন। কখনো নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত বা কখনো চাকরিরত সেনা কর্মকর্তা, কখনো মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, কখনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন বলে জানা গেছে। নিজেকে ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করলেও প্রকৃত অর্থে সে একজন ধুরন্ধর লোক।

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, সাহেদ নিজেকে ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সে একজন ধুরন্ধর, অর্থলিপ্সু ও পাষন্ড। গ্রেফতার রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের দেওয়া তথ্যে অভিযান চালিয়ে সাহেদকে তার পৈতৃক জেলা সাতক্ষীরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। রিজেন্ট হাসপাতালে দুর্নীতি-প্রতারণার অভিযোগে র‌্যাব যে মামলা করেছিল, তার ১৭ আসামির মধ্যে শীর্ষ দুজন হলেন সাহেদ ও মাসুদ। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়। সাহেদ গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে ছিলেন। র‌্যাব প্রধান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ বলেন, ঢাকাসহ কক্সবাজার, কুমিল্লা, সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেছিল। বিভিন্নভাবে যানবাহন ব্যবহার করেছেন। কখনো হেঁটে, কখনো ট্রাকে, কখনওবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব প্রধান বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে কোভিড-১৯ এর প্রায় ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে ছয় হাজারের মতো ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন। এছাড়া সাহেদ একদিকে রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে বিল জমা দিয়েছেন। এছাড়াও সাহেদের বিরুদ্ধে আরো প্রতারণার খোঁজ বেরিয়ে আসছে। রিকশাচালক, বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসার নামে প্রতারণা ছাড়াও এমএলএম ব্যবসার নামে কোটি কোটি হাতিয়ে নেওয়ার খবরও মিলেছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার সাহেদকে প্রায় ১২ ঘণ্টা নিজেদের হেফাজতে রেখে সংবাদ সম্মেলনের পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে তুলে দেওয়া হয়। র‌্যাবের মামলাটি এখন ডিবিই তদন্ত করছে।

নানা কেলেঙ্কারি চেপে রেখে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান বনে বিভিন্ন টেলিভিশনে নিয়মিত মুখ দেখাতেন সাহেদ। নিজেকে তিনি পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সহসম্পাদক। তার ফেসবুক পাতা ভরা বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ছবিতে। মহামারিকালে করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পর ওই হাসপাতালে গত ৬ ও ৭ জুলাই অভিযান চালায় র‌্যাব। তখন হাসপাতালটির নানা দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়ার পর জানা যায়, এ চিকিৎসালয়ের লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গেছে বহু আগে। সমালোচনার মধ্যে সাহেদ লাপাত্তা হয়ে যান। আর র‌্যাবের ওই অভিযানের পর তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবরও সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করে। কিন্তু তা হদিস মিলছিল না।

দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর থেকে গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সাহেদকে গ্রেফতারের সময় তার কাছে গুলিসহ একটি ‘অবৈধ অস্ত্র’ পাওয়া যায় বলেও জানায় র‌্যাব। সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, দালালের মাধ্যমে লবঙ্গবতী নদীর ইছামতিখাল দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছিলেন সাহেদ। গোপন সংবাদে রাত ২টা থেকে ওই এলাকায় অভিযান শুরু করে র‌্যাব। কিন্তু ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। সাহেদকে ঢাকায় আনার পর সকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৬২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেটি সাহেদেরই আরেকটি অফিস বলে জানানো হয়েছে। ওই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার জাল বাংলাদেশি টাকা জব্দ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। এরপর থেকেই পলাতক ছিলেন হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ সাহেদ। ৭ জুলাই রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়। ৯ জুলাই সাহেদের মুখপাত্র তরিকুল ইসলাম ওরফে তারেক শিবলীকে এবং ১৪ জুলাই রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গতকাল ভোরে সাতক্ষীরা থেকে সাহেদকেও গ্রেফতার করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close