প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২২ মে, ২০২০

আম্পানে ব্যাপক ধ্বংসলীলা

* ৭ জেলায় ১৬ জনের মৃত্যু * বিদ্যুৎহীন ১০ লাখ মানুষ * জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল* ভেঙে গেছে বাঁধ, ঘরবাড়ি ও গাছপালা

প্রবল শক্তিধর ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ তা-বে ল-ভ- হয়ে গেছে উপকূলীয় জেলাগুলো। গাছ ও দেয়ালচাপায় এবং নৌকাডুবিতে সাত জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৬ জন। ভেঙে গেছে বাঁধ, ঘরবাড়ি ও গাছপালা। গাছপালা উপড়ে পড়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। বিভিন্ন জেলায় ভেঙে গেছে শহররক্ষা ও বেড়িবাঁধ; প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। জোয়ারের পানি লোকালয়েও ঢুকে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। এ কারণে ঝুঁকি এড়াতে উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তবে স্থলভাগে উঠে আসার পর বৃষ্টি ঝরিয়ে কমতে শুরু করে ঝড়ের শক্তি। গত বুধবার সারা রাতই দেশের উপকূলীয় জেলার পাশাপাশি মধ্যাঞ্চল ও উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলায়ও হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশে আঘাত হানার আগে এই সামুদ্রিক ঝড় তা-ব চালায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ৭২ জন। রাজ্যটিতে পরিকাঠামো, বনজসম্পদ, রাস্তাঘাট ও মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাজ্য সরকার জানিয়েছে আম্পানের আঘাতে কলকাতা ও এর সংলগ্ন ২৪ পরগনা জেলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা টাকার অঙ্কে ১ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কেন্দ্র মোটামুটি ৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানে গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে। সাতক্ষীরা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় শুরু হয় প্রবল ঝড়ো বাতাসের দাপট। উপকূল অতিক্রম করার সময়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫৫ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় দমকা হাওয়া। এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি বৃষ্টি ঝড়িয়ে ক্রমান্বয়ে আরো দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। একইসঙ্গে সতর্ক সংকেত কমিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঝিনাইদহ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ আরো উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে গভীর স্থল নিম্নচাপ আকারে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে অবস্থান করেছিল। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছিল। সাগর উত্তাল রয়েছে। সতর্ক সংকেত সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপৎসংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

ঝড়ো হাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাগুলো এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, যাদের মৃত্যুর খবর এসেছে তাদের বেশিরভাগই ঝড়ে গাছ বা ঘর চাপা পড়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে পিরোজপুর ও যাশোরে তিনজন করে, পটুয়াখালীতে দুজন এবং ঝিনাইদহে, সাতক্ষীরা, ভোলা ও বরগুনায় একজন করে মৃত্যুর খবর পাঠিয়েছেন আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা।

যাশোর : ঝড়ের মধ্যে রাত ১০টার পর যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক মা ও তার শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি। চাঁদপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শাহিনুর রহমান জানান, রাতে প্রবল বাতাসে একটি জাম গাছ ভেঙে ওই পরিবারের কাঁচাঘরের ওপর পড়ে। তাতে মা খ্যান্ত বেগম (৪৫) ও মেয়ে রাবেয়া (১৩) ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং ছেলে আল-আমিন (২২) আহত হন বলে শাহিনুর রহমান জানান। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আবদুর রশিদ জানান, গত বুধবার রাত থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১১ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, যারা ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে অথবা দেয়ালচাপায় আহত হয়েছেন। এদিকে রাত ১১টায় শার্শায় ঝড়ের মধ্যে গাছচাপা পড়ে একজনের মুত্যু হয়েছে। উপজেলার বাগআচড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর টেংরা ওয়ার্ডের সদস্য মুজাম গাজী জানান, টেংরা গ্রামে ঝড়ে গাছ ভেঙে ঘরের ওপর পড়লে মুক্তার আলি নামে ৬৫ বছর বয়সি ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তিনি এলাকায় নসিমন চালাতেন।

পিরোজপুর : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মধ্যে মঠবাড়িয়া উপজেলায় দুজন এবং ইন্দুরকানী উপজেলায় একজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মোজাহারুল ইসলাম। ওই তিনজন হলেন মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের গিলাবাদ গ্রামের মজিদ মোল্লার ছেলে শাহজাহান মোল্লা (৫৫) ও আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামে মুজাহার বেপারীর স্ত্রী গোলেনুর বেগম (৭০) এবং ইন্দুরকানী উপজেলার উমিদপুর এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে শাহ আলম (৫০)। মঠবাড়িয়া থানার ওসি মো. মাসুদুজ্জামান জানান, শাহজাহান মোল্লা মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের পেছনে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোজাহার বলেন, আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামের গোলেনুর বেগম সন্ধ্যায় নিজের ঘর থেকে পাশের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বাতাসের ধাক্কায় তিনি পা পিছলে পড়ে আঘাত পান, ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আর ইন্দুরকানী উপজেলার উমিদপুর গ্রামে শাহ আলমের বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করলে ‘আতঙ্কিত হয়ে’ ঘরের ভেতরেই তার মৃত্যু হয় বলে জানান মোজাহার।

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে রাতে ঝড়ের মধ্যে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ। তিনি বলেন, রাত ১০টার পর ঝড়ের দাপট বাড়লে সদর উপজেলায় হলিধানী গ্রামে একটি গাছ ভেঙে ঘরের ওপর পড়ে নাদিরা বেগম নামে ৫৫ বছর বয়সি ওই নারীর মৃত্যু হয়।

পটুয়াখালী : বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পটুয়াখালীতে। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে গলাচিপা উপজেলায় রাসেদ (৬) নামে এক শিশু ও কলাপাড়ায় শাহ আলম নামে সিপিপির এক কর্মীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর বিষয়টি কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হাসনাত নিশ্চিত করেছেন। ঝড়ের কারণে উড়ে গেছে গলাচিপার বেশ কয়েকটি দোকান। পায়রা নদীর পানির তোড়ে শহররক্ষা বাঁধ ভেঙে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালির ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। রাতে জেলা শহররক্ষা বাঁধ ভেঙে নিউমার্কেটসহ পৌরশহরের কয়েকটি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে। এতে তলিয়ে গেছে নিচু এলাকার রাস্তাঘাট। ভেসে গেছে মাছের ঘেরও।

পিরোজপুর : মঠবাড়িয়া উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে দেয়ালচাপা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়।

ভোলা : পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার আহমেদ জানান, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় বয়স্কভাতা নেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন ছিদ্দিক ফকির। এ সময় দক্ষিণ আইচা এলাকায় তার ওপর গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এছাড়া ভোলার বোরহানউদ্দিনের হাসান ইউনিয়নের রফিকুল ইসলাম (৩৫) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার অফিসার ইনচার্জ মো. এনামুল হক জানান, লক্ষ্মীপুর থেকে ট্রলারে করে ভোলায় আসার পথে আলতু মিয়ার ঘাট এলাকায় মেঘনা নদীতে ডুবে রফিকুল ইসলাম মারা গেছেন।

সাতক্ষীরা : সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চল, আশাশুনি ও সাতক্ষীরা সদরে। ভেঙে গেছে অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা, রাস্তা। ডুবে গেছে মাছের ঘের ও ফসলি জমি। আশাশুনির ছয়টি পয়েন্ট ও শ্যামনগরের একটি পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এদিকে, সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, ঝড়ের মধ্যে মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে গাছের ডাল ভেঙে সদর থানার কামালনগর এলাকার করিমুন্নেসা নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী, গাগড়ামারী, জেলিয়াখালী, নেবুবুনিয়া, গাবুরা বাজার, খোলপেটুয়া ও ৯নং সোরা এলাকায় অধিকাংশ পাউবো বাঁধ খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদে ধসে গেছে। শ্যামনগরের প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঝড়ের প্রভাবে নদীতে জোয়ারের পানির তোড়ে প্রতাপনগরের কুড়ি কাউনিয়া, সুভদ্রা কাটি, চাকলা, হাজরাখালি এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান সাতক্ষীরার খুব কাছ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে অতিক্রম করেছে। এটি রাত ৯টা ৮ মিনিট সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। তখন বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার। এরপর রাত ১১টার পর ঝড়টি শহর অতিক্রম করে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close