গাজী শাহনেওয়াজ

  ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

গ্রামকে শহর করার চিন্তায় সরকারের মেগা পরিকল্পনা

অচেনা হবে না চিরায়ত গ্রাম

* ঠিক রাখা হবে গ্রামীণ অবয়ব * সন্নিবেশ ঘটবে শহরের সুবিধা * পরিবর্তন ঘটবে ১৭ খাতে

অচেনা হবে না গ্রাম। আবহমান বাংলার চিরায়ত অপরূপ সৌন্দর্য অটুট থাকবে। আমূল পরিবর্তন আসবে না সহজ-সরল এ জনপদের সাধারণ মানুষের। সেখানে ঠিক থাকবে সব ধরনের গ্রামীণ অবয়ব। শুধু সন্নিবেশ ঘটবে শহরের সুযোগ-সুবিধা। এসব দেখে শহরে বাবুরা সহজেই বুঝে যাবে এটাই গ্রাম। আর এমন চিন্তার আদলে গ্রামকে শহরে পরিণত করতে নির্দেশনা রয়েছে ডিজিটাল বাংলার রূপকার বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

কাজটি বাস্তবায়নে মেগা পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। সরকারের এই চিন্তাকে যুগোপযোগী বলে মনে করছে দেশের সুশীল সমাজ। তারা বলছেন, উন্নয়নের শিখরে দেশকে পৌঁছে নিতে হলে গ্রামকে শহর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যাবে না। শহরের সমানতালে গ্রামকে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে অগ্রসর জাতিতে পরিণত করতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে গ্রামের প্রাকৃতিক অবয়বকে অক্ষুণœ রাখতে হবে। নগরের মৌলিক সুবিধাগুলো গ্রামে সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের তফাত কমাতে হবে, যোগ করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এ রকম ব্যতিক্রমী চিন্তার সন্নিবেশ ঘটানোয় ভোটারদের মধ্যে অন্যরকম কৌতূহল তৈরি করে দিয়েছিল দলটির এ ইশতেহার। তার প্রভাব পড়ে ভোটের ফলে। বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ।

এদিকে, এত দিন গ্রামকে শহরে করার চিন্তাটি মানুষের মধ্যে আলোচনা ছিল মুখে মুখে। কীভাবে গ্রামকে শহরে পরিণত করবে ডিজিটিল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখা এই সরকার। ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন চাউর ছিলÑ তাহলে গ্রাম বলতে কিছুই থাকবে না। এখন সে চিন্তা ও মানুষের মনের সংশয় দূর হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। কারণ সরকারের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে গবেষণা করে এর একটি ফর্মুলা ও প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয় ছাপিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) গবেষণায় একটি প্রাথমিক ধারণা উঠে এসেছে। সেখানে দুইটি পর্যায়ে পাইলট (পরীক্ষামূলক) প্রকল্পের পথনকশার কথা বলা হয়েছে। একটি প্রকল্প গ্রহণপূর্বক প্রক্রিয়া এবং দ্বিতীয়টি গ্রামীণ জনগণের অংশীদারত্বমূলক কার্যক্রম। আর শহরের সুবিধা সম্প্রসারণে ১৭টি সেক্টর চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সেক্টরের মধ্যে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সুবিধা, তথ্য ও যোগাযোগব্যবস্থা, উন্নত বাসস্থান-স্যানিটেশন-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-পরিবার-পরিকল্পনা, গ্রামীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান-নাগরিক পরিসবা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান (কৃষি-অকৃষি খাত), বাজার ব্যবস্থা, গ্রামীণ নিরাপত্তা ও বাজারব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গ্রামীণ নারী ও শিশুর উন্নয়ন এবং গ্রামীণ যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন। গবেষণার প্রতিবেদনে তারা আরো বলেছে, এই কার্যক্রমের সঙ্গে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত থাকবে। তাই গ্রামে শহরের সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সরাসরি নেতৃত্বে কাজটি পরিচালিত হলে তা অধিক কার্যকর হবে।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু বড় বড় সিটি করপোরেশন নয়, বরং স্থানীয় সরকারের সব স্তরেই আধুনিকায়ন করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সাধারণ জনগণকে সম্ভাব্য সব সেবাই যাতে ইউনিয়ন বা উপজেলা থেকে দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মন্ত্রী বলেন, আমার গ্রাম-আমার শহর কর্মসূচি সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামকে কমিউনিটি ভিত্তিতে তৈরি করা হবে। যেখানে পরিকল্পিতভাবে আবাসিক এলাকা, সুয়্যারেজ সিস্টেম, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন যোগাযোগব্যবস্থা থাকবে। সে আলোকে কাজ চলছে, যোগ করেন রাজনীতি এবং মন্ত্রিসভায় সফল এই মন্ত্রী।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, সরকার দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সব সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে সরকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনে পরিকল্পনামতো কাজ করছে। সরকারের পরিকল্পনা সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ হবে উন্নত এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, কর্দমক্ত এবং সবুজের সমারোহে পাকা-কাঁচা বাড়ি ও রাস্তার চিত্র গ্রামীণ পরিবেশের অন্যতম সৌন্দর্য। নির্বিঘেœ চলাচলের ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় গ্রামকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সব কবিতায় গ্রামকে স্পর্শ করেছে। যার অন্যতম কবিতা আসমানী; ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবাই চাও রহিম উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি রসুলপুরে যাও’ এবং ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাও, ফুলের মালা গলায় গিয়ে মামার বাড়ি যাও’।

জনবান্ধব এই সরকারের চিন্তাও পল্লীকবির রচিত কবিতার বর্ণনা অক্ষুণœ রেখে শহরের সুযোগ-সুবিধা সন্নিবেশ করানো। আরডিএর গবেষণায় তেমনটাই ধারণা রয়েছে। পাইলট প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বলা হয়েছে মাঠপর্যায়ের (জেলা-উপজেলা) কর্মকর্তা জরিপ টিমের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করা এবং এর আলোকে স্বল্প বা মধ্যমেয়াদি প্রকল্প চূড়ান্ত করা, নির্দিষ্ট সময়ান্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে ও সমন্বয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়-বিভাগের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা এবং পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য গ্রামীণ খাসজমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে কমপক্ষে এক একর জমিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কমিউনিটি সেবা কেন্দ্র নির্মাণ করা; সেখানে পাঠাগার, কমিউনিটি হল, সভাকক্ষ, কম্পিউটার কেন্দ্র ও ডিজিটাল সেন্টার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কেন্দ্র ও বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি রাখার গোডাউনের ব্যবস্থা রাখা।

দ্বিতীয় পর্যায়ে গ্রামে শহরের সুবিধা বাস্তবায়নে সব দফতর-সংস্থার সঙ্গে পরামর্শসাপেক্ষে প্রথমে গ্রাম নির্বাচন করা, নির্বাচিত গ্রামের জন্য স্বল্প বা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রাক্কলন প্রস্তুতকরণ ও প্রকল্প সমন্বয়ক নিয়োগদান করা। কাজের সুবিধার্থে প্রয়োজনে উপজেলা প্রকল্প বাছাই, কারিগরি ও বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা যেতে পারে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রকল্পের বাজেট প্রণয়ন, আইএমইডি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন গ্রামগুলোর পাইলট প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং পাইলট প্রকল্পের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্রামকে শহর করার চিন্তাতে আমার দ্বিমত রয়েছে। তবে সরকার যদি গ্রামের অবয়ব ঠিক রেখে শহরের সুযোগ-সুবিধা সন্নিবেশ করে তাহলে চিন্তাটি খুবই যৌক্তিক। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, শহর কেন্দ্রিক রাজনীতি চলছে গ্রাম পর্যায়েও। সেটা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে প্রবর্তন করার কারণে। এতে গ্রামীণ পর্যায়েও হানাহানি শুরু হয়েছে। সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে গ্রাম ও শহরের সুযোগ-সুবিধায় যে ব্যবধান রয়েছে, তা নিরসন করতে হবে। সেই চিন্তা থেকে গ্রামকে সরকারের শহর করার চিন্তা দূরদর্শিতার অংশ। তবে কোন অবস্থায় গ্রামীণ যে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে, সেখানে কোনো পরিবর্তন আনা সমীচীন হবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close