শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

কক্সবাজারে লবণের কেজি ৪ টাকা লোকসানে চাষিরা

কক্সবাজার জেলার উপকূল এলাকায় এখন অপরিশোধিত লবণের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হাজার হাজার মেট্টিক টন লবণ এখনো অবিক্রিত অবস্থায় মাঠে পড়ে রয়েছে। উৎপাদন খরচের বিপরীতে লবণের মূল্য অনেক কম হওয়ায় উৎপাদকরা বিক্রি না করে মাঠে লবণ ফেলে রেখেছেন। লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে দিন দিন হতাশ হচ্ছেন লবণচাষিরা। বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে দাম কমে গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। উৎপাদকদের অভিযোগ, গত বছর প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল সর্বোচ্চ ৫৩০ টাকায়। এ মৌসুমে শুরুর দিকে মণপ্রতি লবণের দাম ছিল ৩০০/৪০০ টাকা, এখন তা প্রতি কেজি ৪ টাকা হারে প্রতি মণ লবণের দাম ১৬০ টাকায় নেমেছে। তাদের আরো অভিযোগ, ক্যামিকেল আইটেমের নামে ‘এইট সিন্ডিকেট’ গোপনে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাবার লবণ) আমদানি করায় চাষি পর্যায়ে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কক্সবাজারে ৬০ হাজার একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ হয়। সেখান থেকে ১৮ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়। এ লবণ দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। তিনি বলেন, লবণের ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে।

চাষি নাছির উদ্দিন ও ফরিদুল আজিম বলেন, গত বছর প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ৪০০/৫২০ টাকায়। এক্ষেত্রে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ১৩ টাকা। লাভের আশায় চলতি মৌসুমের এক মাস আগে মাঠে নামেন চাষিরা। তবে উৎপাদন যত বেশি হচ্ছে, লবণের দামও তত কমে যাচ্ছে। এখন মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাজারে আয়োডাইজ লবণ কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রয় হয়। অথচ মাঠ পর্যায়ে এক কেজি লবণের দাম কমবেশি মাত্র ৪ টাকা। একটি সিন্ডিকেটের পকেটে লাভ ঢুকলেও বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। উৎপাদন খরচের অর্ধেকও দাম পাচ্ছেন না তারা। মাঠ থেকে এক কেজি লবণের উৎপাদন খরচ পড়ছে সাড়ে ৬ টাকা। ২০১৭ সালে ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলার জন্য সরকার জাতীয় লবণনীতি-২০১৬ এর আলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা এখনো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তাই এ পরিস্থিতি বলে মন্তব্য করেন লবণ সংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার সদরের শিল্প নগরী ইসলামপুরের লবণ কারখানার মালিক অছিউর রহমান জানান, লবণের মৌসুম শুরু হলেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি ও খুলনার বড় বড় মিল মালিকদের মধ্যে ইসলামপুরসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় লবণ কিনতে ধুম পড়ে যেত। প্রতিদিন লবণভর্তি শত শত কার্গোবোট, ট্রাক সড়ক ও সমুদ্রপথে চলে যেত ওইসব মোকামে। কিন্তু এখন তা অতীত। ওইসব মিলাররা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত লবণ বাজারজাত করছেন।

ইসলামপুরের লবণ মিল মালিক সমিতির নেতা মো. শরীফ জানান, আমাদের মাঠ ও গুদামে যে পরিমাণ লবণ মজুদ রয়েছে তা বিক্রি করতে পারছি না। লবণের খুচরা মূল্য নেমে এসেছে কেজিতে ৪/৫ টাকা। এতে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

টেকনাফ হ্নীলা লবণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোছাইন মুহাম্মদ আনিম জানান, ন্যায্য মূল্য পাওয়ার আশায় গত মৌসুমে লবণ জমিয়ে বড় ধরনের ভুল করেছি। লবণ চাষ করে বর্তমানে লাখ লাখ টাকার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

নাপিতখালী এলাকার লবণচাষি শাহজাহান চৌধুরী জানান, মাঠে এখনো হাজার হাজার মেট্টিক টন লবণ অবিক্রিত পড়ে আছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে মূল্য কম হওয়ায় লোকসান হচ্ছে বিধায় ওই লবণ এখনো জমা রেখেছেন। পরবর্তী মৌসুম চলে আসার সময় হলেও ব্যবসায়ীরা লবণ বিক্রি করতে পারছেন না। তিনি লবণের ন্যায্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ইসলামপুরের দুটি লবণ কারখানা মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ১০-১৫ বছর ধরে লবণ চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী তিনি লবণ সরবরাহ দিয়ে এসেছেন। কিন্তু গত ৩-৪ বছর ধরে ওইসব কারখানা মালিক তার কাছ থেকে লবণ নেন না। এখন তারা আমদানিকারকদের কাছ থেকেই লবণ কিনছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ে জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি মণ লবণের দাম গড়ে ১৯২ টাকা, যা কেজিতে পড়ছে প্রায় ৪ টাকা ৮০ পয়সা। ২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

গত মৌসুমে (২০১৮-১৯) লক্ষ্যমাত্রা ১৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। গেল মৌসুমে উৎপাদন হয় ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন লবণ অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে ২১ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন মজুদে এসে দাঁড়ায়। অথচ দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসাবে দেশে কেবল মাত্র গেল মৌসুমের উৎপাদিত লবণেই আরো উদ্বৃত্ত রয়েছে ৪ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। যা বিগত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। তবে বেসরকারি হিসেবে মতে জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর ও রামু এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার প্রান্তিক লবণচাষি রয়েছে।

বাংলাদেশ লবণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, গত বছর লবণের মোটামুটি ভালো দাম পাওয়ায় এবার পাঁচ হাজার একর জমিতে অতিরিক্ত লবণ চাষ হচ্ছে। কিন্তু ব্যর্থ হতে চলেছে কৃষকদের রক্ত ঝরা ঘাম।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্রান্তিক চাষিদের স্বার্থ বিবেচনায় যা যা কারণীয় সরকার তাই করবে। লবণের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা আকারে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close