নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২২ জানুয়ারি, ২০২০

শাহজালাল ও শাহ আমানত বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানিং

করোনা ভাইরাসে সতর্ক বাংলাদেশ

চীনে মরণঘাতী নতুন রোগের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। তার নাম ‘করোনা ভাইরাস’। নতুন এই ভাইরাসটি চীনের ইউহান প্রদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। ওই এলাকায় এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ইউহান শহরে প্রথম একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চীনের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এটিকে ‘করোনা ভাইরাস’ বলে শনাক্ত করেছেন। পরে গত সপ্তাহ থেকে এই রোগটি ছড়িয়েছে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরেও। সেখানে মারা গেছে আরো পাঁচজন। এই ভাইরাস ঠেকাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে কড়া নজরদারি শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চীন, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে আসা মানুষের ব্যাপারে কড়া নজরদারি রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। এর অংশ হিসেবে দেশের সবক’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানিং শুরু হয়েছে গত সোমবার থেকে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিমানবন্দরের কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণও দিয়েছে আইইডিসিআর।

আইইডিসিআর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এস এম আলমগীর জানান, চীনের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর প্রমাণ তারা এখনো পাননি বলে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি জানান, সোমবার ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা কর্মী, চিকিৎসক এবং চিকিৎসায় নিয়োজিত কর্মীদের থার্মাল স্ক্যানিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ দিন থেকেই যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানিং শুরু হয়েছে। বিশেষ করে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যে যাত্রীরা বিমানে আসছেন তাদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে।

ডা. এস এম আলমগীর আরো জানান, চীনের ইউহান থেকে কোনো ফ্লাইট সরাসরি ঢাকায় আসে না। কিন্তু আমরা আশঙ্কার জায়গা থেকে চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানিংয়ের পরামর্শ দিয়েছি। একই সঙ্গে আইইডিসিআরের চিকিৎসকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আইইডিসিআর চারটি হটলাইন নম্বর চালু করেছে সার্বক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার জন্য। করোনা-এন ভাইরাস নতুন হওয়ায় এখনো ভাইরাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো কারণ এখনো নেই। ভাইরাসে আক্রান্তদের লক্ষণ সম্পর্কে তিনি জানান, জ্বর দিয়ে শুরু হয়। এরপর কাশি, গলা ব্যথা। অনেকের তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় এবং নিউমোনিয়া ডেভেলপ করে। বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানারে জ্বর থাকলে ধরা পড়বে। স্ক্যানারটা এমনভাবে সেট করা যে, ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা হলেই কম্পিউটারের মনিটরে লাল সিগন্যাল দেখা যায়।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ উল আহসান জানান, বিমাবন্দরের কর্মীদের এর আগে সার্স ভাইরাস ও সোয়াইন ফ্লু নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। ফলে এবার করোনা ভাইরাস হ্যান্ডেল করা সহজ হবে। প্রতিদিন তিনটি ফ্লাইট আসে চীন থেকে। এই ফ্লাইটগুলোকেই সবচেয়ে বেশি নজরদারিতে রাখছি। আর বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রীদের জন্য দুটি থার্মাল স্ক্যানার আছে। সব যাত্রীকেই এই স্ক্যানারের মধ্যদিয়ে যেতে হয়।

গত সোমবার অরিয়েন্টেশনের পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্কসহ নিরাপত্তা কিট দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে হেলথ ডেস্কের বাইরেও আলাদা একটি ডেস্ক চালু করা হয়েছে। ডেস্কে কোনো যাত্রীর ব্যাপারে রিপোর্ট করা হলেই তাকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হবে পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এছাড়া এয়ারলাইন্সগুলোকে প্যাসেঞ্জার হিস্ট্রি দেওয়ার জন্য আলাদা ফরম দেওয়া হয়েছে। যা পূরণ করে জমা দিতে হবে। এয়ারলাইন্সগুলোকে চীন থেকে যেসব যাত্রী আসেন তাদের সেখান থেকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদ জানান, এই ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ প্রকাশ পায় দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। তাই আমরা এখন চীন থেকে যে যাত্রীরা আসছেন তাদের সবাইকে একটি কার্ড দিয়ে দেব। তাতে যোগাযোগের নম্বর, ঠিকানা ও ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ সব কিছু লেখা থাকবে। যদি লক্ষণ দেখা যায় তাহলে তাকে আমরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও আইইডিসিআরে নিয়ে পরীক্ষা করব। আরো কয়েকটি দেশেও এই ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাচ্ছি। ওইসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ব্যাপারেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে ‘করোনা ভাইরাস’ প্রতিরোধে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং (পরীক্ষা) করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে চীনে সরাসরি ফ্লাইট না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য, দুবাই, ভারত হয়ে কানেকটিং ফ্লাইটে চীন থেকে অনেকে আসেন। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সরওয়ার-ই-জামান বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ চীন থেকে আসা যাত্রীদের স্ক্রিনিং করছে। যদি কানেকটিং ফ্লাইটের কোনো যাত্রীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ রয়েছে কিনা সেটির ওপর নজর রাখছেন চিকিৎসকরা। চীন থেকে আসা যাত্রীদের বিষয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের জানাতে ইমিগ্রেশনে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, গত শুক্রবার থেকে স্ক্রিনিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে শাহ আমানতে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে সতর্কতা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিমানবন্দর এলাকায়। পালাক্রমে চিকিৎসক ও মেডিকেল টিম কাজ করছে। এখনো পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ আছে এমন যাত্রী পাওয়া যায়নি। তবে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর।

ভাইরাসের উৎস : ‘করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনো গবেষকরা বুঝে উঠতে না পারলেও অনুমান করা হচ্ছে পশু-পাখির সংস্পর্শে থাকা মানুষজনই মূলত এই ভাইরাসের শিকার। তবে এ নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে এখনো পৌঁছতে পারেনি গবেষক ও চিকিৎসক মহল। চীনে প্রথম দেখা গেলেও সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডেও অসুখটি ছড়িয়ে পড়েছে।

রোগের উপসর্গ : এই ভাইরাসের কারণে সর্দি-কাশির উপসর্গ থাকে। সাধারণত অসুখ বেড়ে নিউমোনিয়ায় পরিণত হতে পারে। সঙ্গে প্রবল তাপমাত্রা থাকে শরীরে। কারো ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্টও হয়। সাধারণত সর্দি-কাশির এই ভাইরাস ৬ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত সহজগম্য। তাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে ও শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে এর শিকার হতে পারেন যে কেউ।

এই ভাইরাসের প্রতিষেধক নেই : বিশ্বজুড়েই প্রায়ই অকারণ ও অত্যাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে শরীরে সুপারবাগসের উপস্থিতি সমস্যায় ফেলছে রোগী ও চিকিৎসককে। যখন-তখন ইচ্ছ মতো অ্যান্টিবায়োটিক নিতে নিতে শরীরে তৈরি হচ্ছে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ বা ‘অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স’। এর হাত ধরেই গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ে ভাইরাসের বিপদ।

প্রতিরোধের উপায় : চিকিৎসকদের মতে, যেহেতু বাংলাদেশে এই ভাইরাসের উৎপত্তি নয়, তাই এর প্রতিরোধ করতে গেলে আপাতত বিমানবন্দরে নজরদারি চালানোই একমাত্র উপায়। এ পদ্ধতিতেই কয়েকটি ভাইরাসের হানা ঠেকিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close