আদালত প্রতিবেদক

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

রাজধানীর পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা

১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড

উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা

প্রায় দুই দশক আগে রাজধানীর পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিচার শেষে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ১০ জঙ্গির ফাঁসির রায় এসেছে। ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম গতকাল সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার জীবিত ১২ আসামির মধ্যে দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে যে দিনটিতে বোমা হামলায় পাঁচজন নিহত হন, ১৯ বছর পর সেই একই তারিখে রায় দিলেন আদালত।

বিচারক তার ১০৪ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি আসামিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে নারকীয় হত্যাকান্ড চালায়।

আদালত আরো বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে কারণে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং সমুন্নত রাখার জন্য হরকাতুল জিহাদের এ জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করে। পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে বিচারক বলেন, আসামিরা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম বাংলাদেশের (হুজি) সদস্য। তাদের ধারণা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লোকরা কাফের, বিধর্মী, নাস্তিক, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নয়, ইসলাম ধর্মের শত্রু এবং আল্লাহ খোদা মানে না। সে কারণে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আসামিরা এ বোমা হামলা চালায়।

কোরআনের সুরা আল মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াত থেকে উদ্ধৃত করে বিচারক বলেন, নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করল।

হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানও ছিলেন এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি। অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দশ আসামির মধ্যে মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। আর জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নুর ইসলাম পলাতক। এই দশ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। এছাড়া পলাতক দুই আসামি মো. মশিউর রহমান ও রফিকুল আলম মিরাজকে খালাস দিয়েছেন বিচারক।

আদালতে উপস্থিত আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম বলেন, মশিউর ও মিরাজ ছিলেন সিপিবির কর্মী। রায়ে বিচারকও সে কথা বলেছেন। এ রায়ের জন্য সকাল থেকেই আদালতপাড়ায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা।

এই সমাবেশ শুরুর কিছুক্ষণ পরই বিস্ফোরিত হয়েছিল পেতে রাখা বোমাটি। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির লাল পতাকা সমাবেশে এই বোমা হামলা হয়েছিল। তাতে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মন্ডল, রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আবদুল মজিদ, ঢাকার ডেমরার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের শ্রমক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের কর্মী মোক্তার হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ দিন পর মারা যান খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রদাস রায়। হামলায় আহত হয় শতাধিক।

ওই ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান মতিঝিল থানায় মামলা করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে দুই বছর পর ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোমিন হোসেন। তিনি আদালতকে বলেন, তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হামলার পর ওই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনায় বর্ষবরণের উৎসবে একই ধরনের বোমা হামলা হয়। কিন্তু তখন জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও তাদের তৎপরতার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর ছিল কম। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে জঙ্গি হামলার সঙ্গে যোগসূত্র পেয়ে ২০০৫ সালে সিপিবির সমাবেশে হামলার মামলাটির তদন্ত পুনরায় শুরু হয় আদালতের আদেশে।

সাত তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক মৃণাল কান্তি সাহা ১৩ আসামির বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় বিচার।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। তবে আসামিপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেননি। গত বছরের ১ ডিসেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে এ মামলার রায়ের জন্য ২০ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন বিচারক।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close