আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

আন্তর্জাতিক আদালতে শুনানিতে গাম্বিয়ার পাল্টা বক্তব্য

সু চির বক্তব্য প্রতারণামূলক

নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার তৃতীয় দিনের শুনানি গতকাল বৃহস্পতিবার হয়েছে। শুনানির প্রথমার্ধে গাম্বিয়া যুক্তিখ-ন করেছে। এর আগে গত বুধবার আদালতে মিয়ানমারের পক্ষে সু চি নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তবে তার ওই বক্তব্যকে ‘ফ্রড’ বা প্রতারণামূলক বলে উল্লেখ করেছেন গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবী পল রিখলার। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের জন্য দায়ী সেনাদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখা যায় না বলেও দাবি করেছেন তিনি।

গতকাল শুনানির শুরুতে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন পল রিখলার। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার বুধবার যে বক্তব্য দিয়েছে, তা ‘ফ্রড’ বলে অভিহিত করেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমার ব্যর্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কোনো সেনা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে জড়িত থাকলে সে ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের বক্তব্য অবিশ্বাস্য বলে উল্লেখ করেন রাইখলার। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় কোনো সেনা জড়িত থাকলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেÑ এমন আশ্বাস কীভাবে বিশ্বাস করা যায়, যেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইংসহ শীর্ষ ছয় সেনা কর্মকর্তা জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন দ্বারা গণহত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত।’ রাইখলার বলেন, মিয়ানমার শুনানির সময় তার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা চরম সহিংসতার বেশির ভাগ অভিযোগকে অস্বীকার করার চেষ্টাও করেনি। মিয়ানমারের আইনজীবী গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন, যা গাম্বিয়ার আবেদনেও রয়েছে। এগুলোও মিয়ানমার অস্বীকার করেনি বলে উল্লেখ করেন রাইখলার। শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষের প্রধান আইনজীবী আরো বলেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি একবারও ব্যবহার করেননি। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথা বলতে গিয়ে তাদের মুসলিম হিসেবে তুলে ধরেছেন।

গণহত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত সেখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা’ নেওয়ার জন্য আদালতের কাছে গতকাল আবার আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া। খবর বিবিসি, এপি, রয়টার্সের।

গত মাসে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) পক্ষে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চালানো গণহত্যার ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে গাম্বিয়া। দ্য হেগে অনুষ্ঠিতব্য মামলার শুনানির শেষ দিন আজ।

গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলি পল রিখলার মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত বিচারকদের কাছে বারবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাময়িক পদক্ষেপ দাবি করেন। তিনি বলেন, শুনানির সময় মিয়ানমার এমনকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ বা ২০১৭ সালের সাঁড়াশি অভিযানের পর রোহিঙ্গাদের ব্যাপকভাবে দেশান্তরের অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি।

গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীকে বিচারের ভার দেওয়া যায় না

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। মামলার শুনানির তৃতীয় ও শেষ দিনে গাম্বিয়ার পক্ষে মার্কিন আইনজীবী পল রিখলার ট্রাইব্যুনালকে বলেছেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের তদন্তে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাংসহ শীর্ষ ছয় সেনা কর্মকর্তা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। তাদের ফৌজদারি অপরাধের দায়ে বিচারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে বিচারের ভার তুলে দেওয়া যায় না।

২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকা-, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বাস্তবতায় জীবন বাঁচাতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া।

মামলায় নিজ দেশের আইনি লড়াইয়ে নেমে শুনানির প্রথম দিন বুধবার সু চি দাবি করেন, মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সামরিক আদালতে অপরাধী সেনা সদস্যদের বিচার হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় সেনা সদস্যদের সাজা পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের দ্রুত বিচার চলছে দাবি করে সু চি বলেন, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ হলে দোষী সেনা সদস্যদের বিচার প্রক্রিয়া থমকে যাবে। আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার চেয়ে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার প্রক্রিয়া সব সময় দ্রুত সম্পন্ন হয়।

সু চির যুক্তি খ-ন করতে গিয়ে গতকাল গাম্বিয়ার পক্ষের মার্কিন আইনজীবী পল রিখলার বলেছেন, ২০১৭ সালের অভিযানের সময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চরম সহিংসতা এবং এর ফলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বিতাড়িত হওয়ার অভিযোগ মিয়ানমার নিজেও অস্বীকার করেনি। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার অভিযুক্ত সেনাদের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

১৭ বিচারকের প্যানেলকে রাইখলার বলেন, ‘যখন কি না জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেল মিন অং হ্লাংসহ শীর্ষ ছয় সেনা কর্মকর্তাকে রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে এবং ফৌজদারি আইনে তাদের বিচারের সুপারিশ করেছে; তখন কী করে আমরা আশা করতে পারি যে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে তারা নিজেরাই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে?’

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগে কয়েকজন সেনা সদস্য ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল শুরুর ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। ২৬ নভেম্বর নিজস্ব আদালতে এই কথিত বিচার শুরু করেছে তারা। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের ঘটনায় আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুনানি শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে এই বিচার শুরু করে দেশটি। এর আগে মিয়ানমারের ইন ডিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার দায়ে ৭ সেনা সদস্যকে ১০ বছরের কারাদ- দেওয়া হলেও এক বছরেরও কম সময় কারাভোগের পর গত নভেম্বরে তারা মুক্তি পায়।

গতকাল গণহত্যা মামলার শুনানিতে গাম্বিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসতা বন্ধে তাদের পদক্ষেপের বিষয়টির ব্যাপারে কোনোভাবেই মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কাছে মামলার পূর্ণ শুনানি না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সংযত রাখতে ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা’ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কি সন্ত্রাস মোকাবিলার পথ : গাম্বিয়ার প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শুনানিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছেন, রাখাইনে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। শুনানির তৃতীয় দিনে মামলার বাদী গাম্বিয়া সেখানে সংঘটিত নারী নিপীড়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছে, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কি সন্ত্রাস মোকাবিলার পথ? গতকাল গাম্বিয়ার আইনজীবী মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রশ্ন তোলেন, এমন কর্মকা-ের মাধ্যমে কি সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে হয়?

মঙ্গলবার বিচার প্রক্রিয়ার প্রথম দিনে বাদীপক্ষের অভিযোগ শোনা হয়। দ্বিতীয় দিনে মিয়ানমারের হয়ে কথা বলেন সু চি। শুনানির শেষ দিনে (১২ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টায় দেড় ঘণ্টা বলার সুযোগ পায় গাম্বিয়া। বিরতির পর রাত সাড়ে ৯টা থেকে দেড় ঘণ্টা নিজেদের যুক্তি তুলে ধরবে মিয়ানমার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close