জুবায়ের চৌধুরী

  ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৯

কানাডার গ্লোবাল নিউজের অনুসন্ধান

শীর্ষ সন্ত্রাসী জয়ই কি কানাডার ব্যবসায়ী তারেক রানা!

কানাডায় ভারতীয় নাগরিক পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে ব্যবসা করছেন তারেক রানা। ২০১১ সালে পর্যটক ভিসায় কানাডায় যান। ২০১৪ সালে কানাডার অভিবাসন দফতর ১০ বছরের ভিসা দেয় তাকে। এরপর শুরু করেন প্রপার্টি কেনাবেচার ব্যবসা। এই কয় বছরে কানাডার অ্যায়াক্স শহরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বনে যান। তার উঠবস ছিল সেখানকার মন্ত্রী আর মেয়রের সঙ্গে। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়মিত ডোনেশনও দিতেন! কেউ হয়ত ভাবতেই পারেননি, এই তারেক রানাই ইন্টারপোল ঘোষিত বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ানটেড’ শীর্ষ সন্ত্রাসী খোন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয়। সম্প্রতি ব্যবসায়ী তারেক রানা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জয় যে একই ব্যক্তি সে সংক্রান্ত একটি বিশদ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কানাডার সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল নিউজ’। ওই নিউজটির পর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাতেও প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এ নিয়ে কানাডা, ভারত ও বাংলাদেশে তোলপাড় চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নড়েচড়ে বসেছে। গ্লোবাল নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ী তারেক রানার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘মোস্ট ওয়ানটেড’ সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম জয়ে মধ্যে বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। পুলিশের তথ্য এবং আদালতের নথি বলছে, বাংলাদেশের সেভেন স্টার গ্রুপের এই নেতা ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতার হন। কলকাতায় তিনি তারেক রানা নামেই অবস্থান করছিলেন। যখন গ্রেফতার হন তখনো একই নাম রেকর্ড করা হয়েছিল। আবার কানাডার অ্যায়াক্সের ওই ব্যবসায়ীর নামও তারেক রানা। ২০০৭ সালে কলকাতায় গ্রেফতারের পর যে ছবি তোলা হয়, তা প্রকাশ পেয়েছিল। ভারতীয় আদালতে মো. তারেক রানার নামে ইস্যু করা একটি ভারতীয় পাসপোর্টও জমা দেওয়া হয়। অ্যায়াক্স ব্যবসায়ীর জন্ম তারিখ, বাবার নাম, স্ত্রীর নাম সেই গ্রেফতারকৃত তারেক রানার সবকিছুর সঙ্গেই মেলে। সেই পাসপোর্টটি রানাকে দেখালে এটা যে তারই তা তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তার ক্ষেত্রে পরিচয় চুরির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন।

ই-মেইলের মাধ্যমে গ্লোবাল নিউজকে তারেক রানা জানান, ‘কেউ একজন আমার পাসপোর্ট এবং ছবি ব্যবহার করছে। এ জন্যে আমি সত্যিই আতঙ্কিত।’ তার দাবি, তিনি স্রেফ একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী যিনি ওয়ার্ক পারমিটের বদৌলতে কানাডায় বসবাস করছেন। কিন্তু রানা এবং মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তির মধ্যে মিলগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কলকাতা আদালতের নথি অনুযায়ী, তারেক রানা ১২ বছর আগে ভারতে গ্রেফতার হন। সেই রানার সঙ্গে বর্তমান রানার স্বাস্থ্যগত তথ্যেরও পুরো মিল রয়েছে। ২০০৭ সালে কলকাতায় আথ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্য তার দুই পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। একই ঘটনা কানাডার এই ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। গ্রেফতারকৃত রানার ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বিজনেস রেকর্ড এবং ট্যাক্স রিটার্নের তথ্য পরীক্ষা করে তাকে বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী জয় হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। সেখানে তার জন্ম তারিখ ৩ মার্চ, ১৯৬৭ লেখা আছে। অ্যায়াক্সের ব্যবসায়ীর জন্ম তারিখও একই। সন্দেহভাজন এই ব্যক্তির কলকাতায় গার্মেন্ট ব্যবসা ছিল। প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘গাউস ফ্যাশন’।

তারেক জানান, কানাডা আসার আগে তিনি ওই প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়েছেন। কলকাতায় আটক হওয়া সেই ব্যক্তির বাবার নাম ছিল সোহেল রানা। কানাডার তারেকও জানান, তার বাবার নামও একই। দুজনের মধ্যে কী ভীষণ মিল! নামে, ছবিতে, শরীরী চিহ্নে, পিতৃ পরিচয়ে, জন্ম তারিখে। সব কিছুতে বড় আশ্চর্য রকমের মিল। তারেক রানার দাবি, তিনি কিছুতেই খোন্দকার তানভির ইসলাম ওরফে জয় নন! গ্লোবাল নিউজে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বর্তমানে ‘লাপাত্তা’ তারেক রানা! ফলে বাংলাদেশ-ভারত-কানাডার গোয়েন্দারা তো বটেই, খোদ ইন্টারপোলও নিশ্চিত, তাদের জারি করা ‘রেড কর্নার নোটিস’ যার বিরুদ্ধে, সেই খোন্দকার তানভির ইসলাম জয় এবং কানাডার তারেক রানা আদতে একই ব্যক্তি।

গ্লোবাল নিউজের কাছে তারেক রানার দাবি, তিনি ভারতীয় নাগরিক। কিন্তু শীর্ষ সন্ত্রাসী জয় বাংলাদেশি। তাছাড়া তিনি জয়ের চেয়ে লম্বা। জয়কে যখন গ্রেফতার করা হয়, ওই সময়টাতেই তিনি পায়ের অস্ত্রোপচারের জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কানাডায় স্থায়ী বসবাসের জন্যে তাকে ভারতীয় পুলিশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে। ‘যদি আমি গ্রেফতার হতাম তবে এই সার্টিফিকেট কীভাবে পেলাম?’ গ্লোবাল নিউজকে উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘সেভেন স্টার গ্রুপটা আসলে কি?’

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠে সেভেন স্টার গ্রুপ। রাজধানী ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় ছিল তাদের লক্ষ্য। সময়ের ব্যবধানে তারা বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর এজেন্সি খুলে বসে। জয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে সন্ত্রাসী বাহিনী অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামতো। বেশ কয়েকটি খুন ও গোলাগুলির ঘটনায় এই গ্রুপ জড়িত। ২০০০ সালে জয়কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা চাওয়ার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরই জয়ের বিরুদ্ধে একটি হত্যাকান্ড এবং অস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে। তথ্য রয়েছে, তিনি ২০০১ সালে মালয়েশিয়া চলে যান। ২০০৩ বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। সেই সময় দেশের ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টারও প্রকাশ করেছিল পুলিশ।

জানা গেছে, জয়কে নিয়ে পুলিশের কাছে যেসব মামলা রয়েছে, তার মধ্যে ২০০৬ সালের ১৪ মের রক্তাক্ত ঘটনায় জয় মোস্ট ওয়ান্টেড হয়ে যান। সিঙ্গাপুর থেকে ফোনকলের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের জব রিক্রুটার টার্কি অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের কাছে ৫ কোটি টাকা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা হয়। দুজন মারা যান। হামলার পরও ফোন করে চাঁদা দাবি করেন জয়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর আফতাব আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশের তথ্যমতে, এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ২০০৭ সালে ঢাকার গড গিফট ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিতে গোলাগুলির ঘটনাতেও জয় জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানে ফোন এসেছিল ভারত থেকে। তাদের কাছেও ৫ কোটি টাকা চাঁদা চাওয়া হয়।

এদিকে গত অক্টোবরে তারেক রানার সঙ্গে কথা বলেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে গ্লোবাল নিউজ। প্রতিবেদন প্রকাশের পর তারেক রানাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করে কানাডার অভিবাসন দফতর। এরপর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তিনি ‘উধাও’ হয়ে যান। ওই সময় পরিচিতদের তারেক জানিয়েছিলেন, তিনি কলকাতায় যাচ্ছেন। ২৮ নভেম্বরের মধ্যে ফিরবেন আয়াক্সে। গতকাল শনিবার (৭ ডিসেম্বর) পর্যন্ত তিনি কানাডায় ফেরেননি। কোথায় আছেন তা কেউ জানে না। তবে ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে বাংলাদেশ পুলিশের দাবি, তারেক রানা বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি মহিউল ইসলাম গ্লোবাল নিউজকে জানিয়েছেন, মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীদের তালিকায় ছিল এই অভিযুক্ত ব্যক্তি। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সবার বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। জয়ের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যাকান্ড, দুটি হত্যাচেষ্টা, ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক জখম এবং চাঁদার জন্য শারীরিক ক্ষতির হুমকির অভিযোগ রয়েছে। তারেক রানা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জয় এক ব্যক্তি কিনা সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত চলছে।

২০১৮ সালে কানাডার অ্যায়াক্স শহরের পৌর প্রশাসনের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন তারেক। সেই পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি হঠাৎ করেই ‘উধাও’! তার এই হারিয়ে যাওয়া কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? তবে কি, ভোজবাজির মতোই মোস্ট ওয়ান্টেড ডন তানভিরুল ইসলাম জয়ই হয়ে গেলেন কানাডার ‘প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোক্তা’ তারেক রানা! পর পর উঠে আসা তথ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট, তারেকই জয়ের নতুন ‘অবতার’। কলকাতার পোশাক সংস্থার মালিক যেভাবে কানাডায় ‘এসজে ৭১’ নামে প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান, তাতে তো দুয়ে দুয়ে চার মিলছেই! আর প্রশ্নটা উঠছে, তারেক যদি মোস্ট ওয়ান্টেড জয় না-ই হন, তবে নিজের এত বড় ব্যবসা ফেলে কেন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেলেন!

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close