বদরুল আলম মজুমদার

  ২১ নভেম্বর, ২০১৯

পরিবহন ধর্মঘটে ভোগান্তি

কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহনে সংকট * দাবিতে অনড় শ্রমিকরা * পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারের চেষ্টা

নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের দাবিতে পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। গতকাল বুধবার শ্রমিক ধর্মঘট নতুনমাত্রা পায়। এতে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে শ্রমিকরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলেও বাধা দিয়েছে। ফলে যাত্রী দুর্ভোগ যেমন বেড়েছে সেই সঙ্গে পূর্ণ পরিবহনেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে। গতকাল রাজধানীমুখী ৫০টিরও অধিক কাঁচামালবাহী ট্রাক দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীর ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে। ব্যবসায়ীরা বলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, শ্রমিকদের সঙ্গে শিগগিরই সমঝোতা হবে। এ অবস্থা বেশি দূর এগোতে দেওয়া যাবে না।

জানা গেছে, আইন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। মন্ত্রীরা কড়া কড়া বক্তব্য রাখলেও সরকার সমাধানের পথেই হাঁটছে। অন্যদিকে শ্রমিকরা বলছে, সড়ক আইনের কিছু ধারা সংশোধন না করলে তারা রাজপথ ছাড়বেন না। এ অবস্থায় সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলো মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এ নিয়ে সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের উদ্দেশে নোয়াখালীতে দলের আঞ্চলিক সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিজেদের শাস্তির ভয়ে জনগণকে শাস্তি দেবেন না। জনগণকে দুর্ভোগে ফেলবেন না প্লিজ।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আজকে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করছেন। আশা করি, আলোচনার পর তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবেন।’ তিনি আরো বলেন ‘আমরা সড়কে শৃঙ্খলার জন্য আইন করেছি। কাউকে জেল-জরিমানা দিতে নয়, শাস্তি দিতে নয়।’

মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালিত হচ্ছে ধর্মঘট। দুই সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা শাজাহান খান এবং মসিউর রহমান রাঙ্গা। কিন্তু তারা সেটা অস্বীকার করে বলেন, তাদের দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ধর্মঘট বা কর্মবিরতির কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। কিন্তু তারা দুজনই চলমান দাবিকে সমর্থন করেন।

এদিকে, ধর্মঘটে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মির্জাপুর, ইচাইল, কর্ণী, শুভুল্যা ও কদিম ধল্যা এলাকায় উত্তরাঞ্চলগামী দু’একটি বাস, কিছুসংখ্যক ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চললেও টাঙ্গাইল থেকে ঢাকাগামী কোনো বাস চলাচল করেনি। ময়মনসিংহের মাসকান্দা আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, পাটগুদাম ব্রিজ বাসস্ট্যান্ড ও উত্তরবঙ্গ বাসস্ট্যান্ড থেকে গতকালেরও মতো আজও কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বুধবার সকাল সোয়া ৬টা থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ও সাইনবোর্ড এলাকায় একদল পরিবহন শ্রমিক সড়কে অবস্থান নেয়। পরে তারা সেখানে চলাচলরত গাড়ি আটকে দেয় এবং মহাসড়কের দুই পাশে গাড়িগুলো এলোমেলো করে রেখে রাস্তা অবরোধ করে রাখে।

গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও গাজীপুর-কোনাবাড়ী সড়কে দূরপাল্লার গাড়ি চলেনি। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় বেশ কয়কজন পরিবহন শ্রমিককে লাঠিসোটা নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি দেখলেই থামিয়ে দেয়। এছাড়া গাজীপুরের সালনা, রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা, মির্জাপুর মাস্টারবাড়ি, ভবানীপুর, গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি, মাওনা চৌরাস্তা এলাকার সড়কেও দূরপাল্লার কোনো যান চলাচল করেনি।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, গতকাল থেকে বাস চালানোর আশ্বাস দিলেও তা মানা হয়নি। সকাল থেকে দূরপাল্লার ঢাকাগামী বাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। খুলনা প্রতিনিধি জানায়, খুলনার অভ্যন্তরীণ সড়কপথে গতকাল থেকে বাস চলাচলের কথা থাকলেও চলেনি। সকালে বাস ছাড়বে এমন খবরে সোনাডাঙ্গা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, রয়েল ও শিববাড়ীর মোড়ে শত শত যাত্রী ভিড় জমায়। এ সময় বেশির ভাগ বাস কাউন্টার বন্ধ দেখা যায়।

বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়া থেকে অভ্যন্তরীণ সব সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস ও সারা দেশে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সকালের দিকে দূরপাল্লার কিছু বাস ছাড়লেও বিকাল নাগাদ তা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ধর্মঘটের ফলে বগুড়া থেকে জয়পুরহাট, রংপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের সড়কপথে সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। বগুড়া হয়ে ঢাকা-নওগাঁ, ঢাকা-জয়পুরহাট, ঢাকা-রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে।

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানায়, গতকাল সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ রয়েছে। দাউদকান্দির গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পরিবহন শ্রমিকরা অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় চলাচলরত গাড়িচালকদের মুখে পোড়া মবিল মেখে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে দাউদকান্দি থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবরোধ ছত্রভঙ্গ করে। ফলে ফ্লাইওভারের উভয় পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানায়, পটুয়াখালীতে গতকাল ভোর থেকে দূরদূরান্তের যাত্রীরা বাস টার্মিনালে এসে দুর্ভোগে পড়েন। গন্তব্যে পৌঁছাতে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বিকল্প যানে যেতে হচ্ছে। এই সুযোগে ইঞ্জিনচালিত স্থানীয় যান মহেন্দ্র, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের মালিকরা কয়েক গুণ ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানায়, গতকাল সকাল ৯টা থেকে ফরিদপুরের সব সড়কপথে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল ১০টার দিকে ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, অন্যান্য স্থানের শ্রমিক দলের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন ফরিদপুরের বাস শ্রমিকরা।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানায়, সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক দিয়েও যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

উল্লাপাড়া প্রতিনিধি জানায়, গতকাল বুধবার উল্লাপাড়া হয়ে নগরবাড়ী-বগুড়া মহাসড়কে কোনো বাস চলেনি। পাবনা-ঢাকা দূরপাল্লার কোচও চলাচল বন্ধ রয়েছে। উল্লাপাড়া থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের বেশ দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। উল্লাপাড়া হয়ে সৈয়দপুর, রংপুর, হিলি, রাজশাহী রুটে মেইল সার্ভিসের বাস চলাচল করলেও গতকাল কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।

নাটোর প্রতিনিধি জানায়, নাটোরে দূরপাল্লার কোচ ও আন্তঃজেলা বাস চলাচল করলেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম। ফলে যাত্রীদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে করে তাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি লক্ষণ পোদ্দার জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত তারা ঠিকভাবে গাড়ি চালিয়েছেন। কিন্তু গতকাল পাবনার মুলাডুলি থেকে তাদের বাস ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হিলি প্রতিনিধি জানায়, সারা দেশের মতো হিলিতেও চলছে পরিবহন ধর্মঘট। তবে সকাল থেকেই বন্দরে স্বাভাবিক রয়েছে আমদানি-রফতানি। অন্যদিকে বন্দরের অভ্যন্তরে লোড-আনলোড স্বাভাবিক রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close