মজিবুর রহমান খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

  ১৩ নভেম্বর, ২০১৯

উদয়নের পেটে তূর্ণা : নিহত ১৬

২ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ যাত্রী মারা গেছে। কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের ক্রসিংয়ে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে আন্তনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মাঝামাঝি বগিতে ঢুকে পড়লে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছে আরো শতাধিক নারী-পুরুষ। হতাহতরা সবাই উদয়ন ট্রেনের যাত্রী। তূর্ণা নিশীথার চালক ও সহকারীর দায়িত্বহীনতার কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্ত করে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আইনমন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রেলওয়ে মহাপরিচালক, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে থেকে উদ্ধারকাজ তদারকি করেছেন।

এদিকে, দুর্ঘটনার পরপরই তূর্ণা নিশীথার লোকো মাস্টার (চালক) তাছেন উদ্দীন ও সহকারী লোকো মাস্টার অপু দে পালিয়ে গেছেন। তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ করে টাকা এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।

কসবা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার জাকের হোসেন জানান, দুর্ঘটনার পরপরই ট্রেনের ইঞ্জিন চালু রেখেই তূর্ণা নিশীথার চালক ও সহকারী চালক পালিয়ে যান। পরে সকাল ৮টার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেন এসে তূর্ণা নিশীথার ইঞ্জিন বন্ধ করে।

রেলওয়ে স্টেশন, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর ট্রেন ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা মঙ্গলবার রাত ২টা ৪৮ মিনিটে শশীদল রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। পথে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশের আগেই আউটারে থামার জন্য লালবাতি জ্বালিয়ে সংকেত দেন স্টেশন মাস্টার। অপরদিকে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস কসবা রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ পথে স্টেশন মাস্টার তাকে মেইন লাইন ছেড়ে দিয়ে ১ নম্বর লাইনে আসার সংকেত দেন। কিন্তু তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের চালক সিগন্যাল (সংকেত) অমান্য করে দ্রুতগতিতে ট্রেন চালান। এ সময় উদয়ন ট্রেনের মাঝামাঝি তিনটি বগির সঙ্গে তূর্ণা নিশীথার ইঞ্জিনের সংঘর্ষ হয়। এতে উদয়ন ট্রেনের তিনটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে উদয়ন ট্রেনের ১৬ যাত্রী মারা যান এবং শতাধিক নারী-পুরুষ আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছয়জনই হবিগঞ্জ জেলার।

নিহতরা হলেনÑ হবিগঞ্জ পৌরসভার আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা ও হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আলী মোহাম্মদ ইউসুফ (৩২), বানিয়াচংয়ের মদনমোরাদ গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে আল আমিন, সোহেল মিয়ার মেয়ে সোহা মনি (৩), টাম্বুলিটুলা মহল্লার সোহেল মিয়ার মেয়ে আদিবা আক্তার (২), বহুলা গ্রামের আলমগীর মিয়ার ছেলে ইয়াসিন মিয়া, চুনারুঘাটের পীরেরগাঁও গ্রামের মৃত আবদুল হাশেমের ছেলে হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র আশিকুর রহমান সুজন, উলুকান্দি গ্রামের ফরিদ মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া, একই গ্রামের পিয়ারা বেগম (৩২), চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের রাজাগাঁও এলাকার মজিবুর রহমান (৫০), তার স্ত্রী কুলসুম (৪২), চাঁদপুর সদর উপজেলার উত্তর বালিয়া গ্রামের বিল্লাল মিয়াজির মেয়ে ফারজানা আক্তার (১৫), হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ ঈশানপুর গ্রামের মইন উদ্দিনের স্ত্রী কাকলী আক্তার (২০) ও মরিয়ম বেগম (৬), মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার মুসলিম মিয়ার স্ত্রী জাহেদা বেগম (৪৮), নোয়াখালীর বড় মসজিদ পাড়ার সুইপার কলোনির শংকর হরিধনের ছেলে রবি হরিধন (২৫) এবং অজ্ঞাত এক নারী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ঘটনাস্থলে আটজন এবং বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান আরো আটজন।

নিহতদের পরিচয় জানতে বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের সদস্যরা নিহতদের হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে তাদের পরিচয় শনাক্ত করেছেন। লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

ঘটনার পর থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-সিলেট, নোয়াখালী-ঢাকা, নোয়াখালী-সিলেট রেলপথে সব ধরনের ট্রেন চলাচল ৮ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। রেলওয়ে ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আখাউড়া ও লাকসাম থেকে রিলিফ ট্রেন এসে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে। তাছাড়া সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, জেনেটিক কম্পিউটার একাডেমি মুক্ত স্কাউট গ্রুপ, সিডিসি মুক্ত স্কাউট গ্রুপ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেছে।

রেল সচিব মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। রেলের দুটি কমিটির একটিতে প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিতু মরিয়মকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী বলেন, নিশীথা ট্রেনটি আউটারে মেইন লাইনে থামার সংকেত দেওয়া হয়েছিল। উদয়ন ট্রেনটিকে মেইন লাইন থেকে ১নং লাইনে আসার সংকেত দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসাবে উদয়ন ট্রেন ১ নম্বর লাইনে প্রবেশ করছিল। এ সময় নিশীথা ট্রেনের চালক সংকেত অমান্য করে উদয়ন ট্রেনের ওপর উঠে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কেএম হুমায়ুন কবির বলেন, কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনজন মারা গেছে। ২৯ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। দু-তিনজন ছাড়া বেশির ভাগই গুরুতর আহত।

উপজেলা চেয়ারম্যান রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে উদ্ধারকাজ করছি। বায়েক শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে ও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ উল আলম বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন শাহ আলম জানান, আহতদের সদর, কসবা ও আখাউড়া হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খান জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। মরদেহ দাফন-কাফনের জন্য এই টাকা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে আমাদের হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নিহত জেলা ছাত্রদল সহসভাপতি আলী মো. ইউসূফ শহরতলির আনোয়ারপুর গ্রামের মৃত হাসান আলীর ছেলে। আলী ইউসূফ রাজনীতি করার পাশাপাশি স্থানীয় লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

এদিকে, ভয়াবহ এ ট্রেন দুর্ঘটনায় আলী মো. ইউসূফের মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। তার এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন তারা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close