নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১২ নভেম্বর, ২০১৯

কে এই ওয়াহিদুল হক

একাত্তরে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করেন

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ওয়াহিদুল হকের মোবাইল ফোনে থাকা দুই অডিও রেকর্ডের কারণে আপসারণ করা হয়েছে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে। এই ওয়াহিদুল হক হলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক এই সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে। ওয়াহিদুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে দুই বছর পর তিনি পুলিশে যোগ দেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থায় দায়িত্ব পান এবং এরপর গত শতকের শেষদিকে পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক হন।

প্রসিকিউশন বলছে, পাকিস্তান আর্মির সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর রংপুর ক্যান্টনমেন্টে হত্যা, গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেন মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হক।

অভিযোগ : ১৯৭১ সলের ২৮ মার্চ আনুমানিক বিকাল ৪টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী হাজার হাজার বেসামরিক জনগণ রংপুর সেনানিবাসের দক্ষিণে কোতোয়ালি থানা এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখানে তারা ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছিলেন।

অভিযুক্ত আসামি মেজর (অব.) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের (একাত্তরে তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ২৯ ক্যাভালরি (অশ্বারোহী) রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ছিলেন) নেতৃত্বে সশস্ত্র সেনাবাহিনী সেদিন মেশিনগান দিয়ে মুক্তিকামী মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ বেসামরিক লোককে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, সেদিন যারা আহত হয়েছিলেন, তাদের কয়েকজনকে পরে ফাঁসি দিয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাগের। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৫ জনের নাম-পরিচয় আনুষ্ঠানিক অভিযোগে তুলে ধরেছে প্রসিকিউশন।

অভিযুক্ত মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হক সেদিন সক্রিয়ভাবে ‘গণহত্যায়’ অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া ‘অন্যান্য অমানবিক আচরণ’, ‘নির্যাতন’, ‘হত্যা’র মাধ্যমে ১৯৪৩ সালের জেনেভা কনভেনশনের ৩(২) (কে) (ই) (জি) (জ) ধারা লঙ্ঘন করে তিনি অন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩ ২০(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তালিকাভুক্ত করা হয়। সে অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত শুরু হয়।

তদন্ত কাজকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এমন অভিযোগ উঠলে ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পরে গত বছরের ২৪ এপ্রিল দুপুরে গুলশানের বারিধারার বাসা থেকে ওয়াহিদুল হককে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনাল তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। তদন্ত শেষে প্রসিকিউশন যে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে, তা আমলে নিয়ে চলতি বছর ২৫ মার্চ অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৬৬ সালের ১৬ অক্টোবর মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১১ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে কমিশন পান। পরে তাকে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। ১৯৭০ সালের মার্চে ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট রংপুর সেনানিবাসে স্থানান্তরিত হলে ওয়াহিদুল হকও সেখানে চলে যান। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ওই রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন তিনি। ওই বছরই তিনি বদলি হয়ে আবার পাকিস্তানে (পশ্চিম পাকিস্তান) চলে যান। সেখানে তিনি ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন ওয়াহিদুল হক। ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর তাকে বাংলাদেশ পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৯৭৭ সালে কুমিল্লার এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াহিদুল। পরের বছর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ১৯৮২ সালে নোয়াখালী জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তান আমলের এই সেনাসদস্য। এরপর ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ওয়াহিদুল হককে পরে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এনএসআইয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তাকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক করা হয়।

এরপর ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই দায়িত্ব শেষে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের অতিরিক্ত আইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close