নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা ব্যুরো ও বাগেরহাট প্রতিনিধি

  ১০ নভেম্বর, ২০১৯

১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত

উপকূলে বুলবুলের আঘাত

* দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত সশস্ত্র বাহিনী * কালকের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা স্থগিত * আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ লাখ মানুষ * বঙ্গোপসাগরে ১৫ জেলে নিখোঁজ

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল গতকাল শনিবার মধ্যরাতে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে। এর আগে এটি গতকাল সন্ধ্যায় প্রথমে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে আঘাত হানা শুরু করে। বঙ্গোপসাগর উপকূলে দুপুর ১২টা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হলেও সন্ধ্যা ৭টার দিকে বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অংশে আঘাত হানতে শুরু করে। একই সঙ্গে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ ফুট পানির উচ্চতা। এখন ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অগ্রবর্তী অংশ সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড, হিরণ পয়েন্ট, দুবলারচর, মেহের আলীর চর, অফিসকিল্লা, মাঝেরচর, আলোরকোল, মরণেরচরে আছড়ে পড়েছে। ১২০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ছে ঝড়ের তিব্রতা। তছনছ করে দিয়েছে দুবলার চরের অস্থায়ী শুঁটকি পল্লী। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) দুবলারচর ভিএইচএফ স্টেশনের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

পরে ‘বুলবুল’ গতকাল গভীর রাতে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এরই মধ্যে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ১০ নম্বর সতর্কতার আওতায় থাকা জেলাগুলো হচ্ছে ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো। বুলবুলের প্রভাবে এসব অঞ্চলের নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ছিল ঝড়ো হাওয়া। তবে গতকাল রাতে এ রিপোট লেখা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।

সুন্দরবনের দুবলারচর ভিএইচএফ স্টেশনের কর্মকর্তারা আরো জানান, বাগেরহাটের পূর্ব-সুন্দরবন বিভাগের দুবলারচরের অস্থায়ী শুঁটকি পল্লী এলাকার আলোরকোল, মেহেরআলীর চর, মাঝেরকেল্লা, অফিসকিল্লা ও শেলারচরে ২২ বছর আগে নির্মিত হওয়া জরাজীর্ণ পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে ৬ হাজারেরও বেশি জেলেরা আশ্রয় নিতে পেরেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান সংকুলন না হওয়ায় শুঁটকি পল্লীসহ ঝড়ের কারণে সাগর থেকে আসা আরো কয়েক হাজার জেলে নৌযানে করে ছোট ছোট খালে আশ্রয় নিয়েছে। ঝড়ের তীব্রতা বাড়ায় নৌযানে করে সুন্দরবনের খালে আশ্রয় নেওয়া জেলেদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সার্বিক প্রস্তুতির তথ্য নিয়ে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ৩ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার আগেই ১৮ লাখ মানুষকে ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম। ঝড় এগিয়ে আসায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল গতকালের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। গতকাল আরেক ঘোষণায় আগামীকাল সোমবারের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকালের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে তা পরে জানানো হবে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাগর উত্তাল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত সশস্ত্র বাহিনীর সব সেনানিবাস, ঘাঁটি, জাহাজ ও হেলিকপ্টার। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)-এর সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান এ তথ্য জানান।

চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এর কারণে গতকাল সকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি থেকে সব জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে জাহাজ থেকে পণ্য উঠানো-নামানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন পণ্য খালাসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ করে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্দর জেটিতে মোট ১৮টি জাহাজ ছিল। আর বহির্নোঙ্গরে ছিল ১৪৯টি জাহাজ। এর মধ্যে ৫৩টি জাহাজ জেটিতে আসার অপেক্ষায় ছিল। জেটিতে থাকা জাহাজগুলোকে সকালে বহির্নোঙ্গরে পাঠাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি লাইটার জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর উজানে নিয়ে সতর্কাবস্থায় থাকতে বলা হযেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।

১,৫৭৭টি মেডিকেল টিম গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর

স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলায় দেশের দুর্গত ১৫ জেলায় ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ ছাড়াও দুর্গত এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার বাসসকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুসারে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ১৫টি জেলাতে আঘাত হানতে পারে। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে সেই এলাকাগুলোকে দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এসব জেলায় মোট ৪ হাজার ৫১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য মোট ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে ট্রলারসহ ১৫ জেলে নিখোঁজ

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরের নারিকেল বাড়িয়া নামক স্থানে এফবি তরিকুল নামের একটি ট্রলারসহ ১৫ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। বরগুনার নলীবাজারের ট্রলার মালিক সোয়েব জানান, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নিরাপদ আশ্রয়ে আসার সময় ১৫ জেলেসহ তার ট্রলারটি নিখোঁজ হয়ে যায়। ঝড় থেমে যাবার পর ট্রলারের সন্ধানে তিনি বের হবেন বলে জানান।

প্রয়োজনে ৯৯৯-এ কল করার অনুরোধ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল সচিবালয়ে বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় উপকূলীয় জেলা-উপজেলার সব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে; যেন যেকোনো প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায়। রেডক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা উদ্ধার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। তা ছাড়া যেকোনো প্রয়োজনে দুর্গতদের ৯৯৯-এ কল করার অনুরোধ করা হচ্ছে।’

আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ লাখ মানুষ

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বুলবুল আঘাত হানতে পারে এমন এলাকায় ৪ হাজার ৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ৪ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। আরো ১৮ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম তদারকি করছে।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয়েছে। এখান থেকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্যে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা দায়িত্বে রয়েছেন।’

এনামুর রহমান বলেন, ‘গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি যেন ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বা প্রাণ না হারায়, এজন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি জেলায় জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ৫ লাখ টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে এ বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে। ঝড়টি সন্ধ্যা নাগাদ আঘাত করবে, এজন্য রাতে আলোর ব্যবস্থা করতে মোমবাতি ও হ্যাজাক লাইট প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক রাখা আছে।’ এনামুর রহমান বলেন, ‘দেশের সব জলপথে নৌ-চলাচল বন্ধ আছে। জেলে ও মাছ ধরার ট্রলারকে নিরাপদে থাকতে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তা এখনো বলবৎ আছে।’

আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহ!

খুলনা ব্যুরো জানায়, আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে বলা হচ্ছে খুলনার উপকূলের বাসিন্দাদের। চলছিল মাইকিং। তবে ঝুঁকিপূর্ণ অনেক এলাকাবাসী গতকাল সন্ধ্যার সময়েও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে চেষ্টা করছে স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় প্রশাসন। মহাবিপদ সংকেত জারির পরও আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি উপকূলের স্থানীয় লোকজন। তাদের জোর করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্র যেতে চাচ্ছেন না তারা বলেন, আশ্রয়কেন্দ্র গেলে ঘর-বাড়িতে চুরি হতে পারে। এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্র থাকতে ও খেতে অসুবিধা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close