বদরুল আলম মজুমদার

  ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

শিশুর প্রতি কেন এই বর্বরতা

তুহিন মিয়া। পাঁচ বছরের এই শিশুটির ছবি গত দুদিন দেশের মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। শিশুটির দুটি কান ও লিঙ্গ কাটা, ঠোঁট ফাটা, পরনে ছোট একটি গেঞ্জি, তার নিচ দিয়ে পেটে দুটি ছুরি ঢোকানোÑ এ অবস্থায় গলায় রশি বেঁধে মাত্র এক ফুট উঁচুতে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। বর্বর এ দৃশ্যটি নিয়ে দেশব্যাপী চলছে সমালোচনার ঝড়। শিশুদের প্রতি বর্বরতা কোন পর্যায়ে গেছে, তার একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে এই ছবিটি। ঘটনাটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। গত রোববার রাত আড়াইটার দিকে শিশুটিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এর কয়েক মাস আগে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চুরির অপবাদে রাজন নামে একটি ছেলেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে টানা কয়েক ঘণ্টা মারধর করা হলে বাঁধা অবস্থাতেই মারা যায় সে।

শুধু তুহিন মিয়া বা রাজন নয়, সারা দেশে গত কয়েক বছরে শিশুদের প্রতি এমন পৈশাচিকতা বেড়েই চলেছে। এদের প্রতি এমন আচরণ বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনায় সামাজিক অস্থিরতা এবং মানুষের মানসিক অবসাধকে দায়ী করা হচ্ছে। শুধু শিশুহত্যা নয়, কন্যাশিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। কোমলমতি এই শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না অভিভাবকরা। শিশু নির্যাতন রোধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ভয়াবহ এসব নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারছেন না দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্টরা।

দেশের ভবিষ্যৎ ফুলের মতো পবিত্র এই শিশুদের মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের যেখানে আগলে রাখার কথা, সেখানে এই সমাজেরই কিছু বিকৃত মনের মানুষ তাদের ওপর চালাচ্ছে জঘন্য নির্যাতন। এমনকি ঘৃণ্য এই অপরাধের হাত থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না।

দেশব্যাপী শিশুদের ওপর হওয়া নির্যাতনের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শুধু অপরিচিত ব্যক্তি নয়, পরিচিত, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীর দ্বারাও শিশুরা যৌন নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশু অধিকার সুরক্ষায় আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। পথশিশুরা তো বটেই, এমনকি পরিবারের নিরাপদ গ-ির মধ্যে থেকেও এরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদেরও এ নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দ্বারাও কোমলমতি শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। মূলত এ বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারি এবং নির্যাতন রোধে দেশে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ না থাকায় শিশুদের ওপর হওয়া এই নৃশংসতা রোধ করা যাচ্ছে না।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪৪ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেন এই বর্বরতাÑ এ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মেহজাবিন হকের সঙ্গে। তিনি জানান, যেকোনো অপরাধ সংগঠনের জন্য শিশুরা খুব সহজেই নাগালে আসে এবং তারা কিছু বুঝে উঠতে পারে না বলে হীন ইচ্ছা চরিতার্থ করতে শিশুদের টার্গেটে নেওয়া হয়। তা ছাড়া সুনামগঞ্জের ঘটনাটি দেখে বোঝা যাচ্ছে পরিবারের বড় অন্য সদস্যদের সায়েস্তা করতে শিশুদের দিকে নজর দিচ্ছে অপরাধীরা। প্রতিটি মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্যই এটা করা হচ্ছে। এটি এক ধরনের বিকারগ্রস্ত ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, এর বাইরে অনেক শিশু হত্যার শিকার হয় নিজ পরিবার দ্বারা। এগুলো মানসিক ভারসাম্যহীনের কারণে ঘটে থাকে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছুই করার থাকে না।

এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কীÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. জিয়াউর রহমান বলেন, মানুষের আয়বৈষম্য এবং হতাশা থেকে পরিবার পর্যায়ের হত্যাগুলো ঘটে থাকে। আর যৌন নির্যাতনের বিষয়গুলোতে ভিন্ন একটা মোটিভ থাকে। তা ছাড়া ব্যক্তি-শত্রুতার জেরে শিশুহত্যা বা অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে। এগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। উন্নত দেশে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিকে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাউন্সেলিং করা হয়ে থাকে। আমরা এখনো সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। তবে সামাজিক সচেতনতা এবং ধর্মীয় শিক্ষা দ্বারা এ অবস্থা থেকে উন্নত পরিবেশে যাওয়া যায়।

তবে এসব অপরাধ বাড়ার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতিও অনেকাংশে দায়ী। সাধারণত ধর্ষণের মামলায় সাক্ষ্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের সন্নিবেশ ঘটাতে গিয়ে এসব মামলার দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে এ মামলাগুলো চলতেই থাকে। আর নির্যাতনকারী কোনোভাবে আটক হলেও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য প্রভাবশালী মহল থেকে হুমকি বা অর্থের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, গ্রাম্য আদালত ও স্থানীয় সরকারকে এ বিষয়ে সক্রিয় থাকতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বা চেয়ারম্যানকে সচেতন থাকতে হবে। এ ছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি আরো বলেন, দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও অধিকাংশ ঘটনায় বিচার হয় না। তাই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা সমাজের প্রভাবশালী। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দিতেও সাহস পায় না। আমাদের সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই। ফলে কেউ সাক্ষী দিলে তাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। কেউ কোনো অপরাধ প্রতিরোধ করতে গেলে তাকেই অনেক সময় আসামি হতে হয়। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ বা মানবিকতা নেই, তা নয়। মানুষ বর্তমানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। কারণ, বিচারহীনতায় সে ভীত এবং নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কোনো ভালো কাজ বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে এখানে বিপদে পড়তে হয়Ñ এমন একটি ধারণা সমাজে জন্ম নিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন এমন হত্যাকা- সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই শ মানুষকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে একটি অংশ শিশু। তার মতে, এর দুটি দিক আছে। প্রথমত, মানুষ বিচার না পেয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। আর এই বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে আরেকটি গ্রুপ তাদের স্বার্থে শিশুদের হত্যা করছে, নানা ধরনের অপরাধ করছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close