নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ অক্টোবর, ২০১৯

ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের কক্ষ সিলগালা

ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে বুয়েটে দুদিন আন্দোলন স্থগিত

অবশেষে বুয়েটে ভর্তিচ্ছুদের প্রতি ‘সম্মান জানিয়ে’ ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বুয়েট প্রশাসন স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করায় আন্দোলন শিথিল করেছেন তারা। আবরার হত্যাকা-ের দ্রুত বিচারসহ ১০ দফা দাবিতে বুয়েটে আন্দোলন চলছিল। টানা পঞ্চম দিন চলা বিক্ষোভ-সমাবেশ গতকাল শনিবার মাত্র দুদিনের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। সে হিসেবে আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত কোনো আন্দোলন কর্মসূচি নেই। তবে আগামী মঙ্গলবার থেকে ফের ১০ দফা দাবি নিয়ে মাঠে থাকবেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। যদিও এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ দাবিই মেনে নিয়েছে বুয়েট প্রশাসন।

এদিকে বুয়েটের বিভিন্ন হলে অভিযান চালিয়ে অবৈধ, অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের রুম সিলগালা করা শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিকেলে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে এ কাজ শুরু হয়। অভিযানের প্রথম দিন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানী ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের কক্ষ এবং বুয়েট ছাত্রলীগের কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া হয়।

আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা পৌনে ২টার পর জানিয়েছেন, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সম্মান জানিয়ে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে সম্মতি দিচ্ছেন আন্দোলনরতরা। তাই রোববার ও সোমবার আন্দোলন স্থগিত থাকবে। এরপর আবার ১০ দফা দাবি বাস্তবায়নে মাঠে থাকবেন তারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

এর আগে আন্দোলনের মুখে গত শুক্রবার বুয়েট মিলনায়তনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংলাপে বসেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবি মেনে নেন। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ও আবরার হত্যা মামলার ১৯ আসামিকে সাময়িক বহিষ্কার করার ঘোষণা দেন। তবে বেশ কটি দাবি বাস্তবায়নের জন্য সময় চান তিনি।

আবরারের লাশ উদ্ধারের পর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠে বুয়েট ক্যাম্পাস। একপর্যায়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। র‌্যাগিংসহ শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধসহ ক্যাম্পাসে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা শুরুতে সাত দফা ও পরে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করতে থাকেন। এদিকে টানা আন্দোলনের মুখে ১৪ অক্টোবর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের হুমকিও দিয়েছিলেন আন্দোলনরতরা। কিন্তু গতকাল তারা সে অবস্থান থেকে সরে আসেন। ভর্তি পরীক্ষা সামনে রেখে দুদিন আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন তারা। তবে গতকাল বুয়েট প্রশাসনের কাছে স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য পাঁচ দফা দাবি তোলে ধরেন তারা। এই পাঁচ দফা দাবি মেনে নিয়ে আলাদা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বুয়েট প্রশাসন।

গতকাল সকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা পূরণ করে বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেছেন বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান। এই বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা আগামী ১৩ ও ১৪ অক্টোবর আন্দোলন শিথিল করেছেন। এই পাঁচ দফা দাবি দ্রুত পূরণে গত শুক্রবার রাতে বুয়েট কর্তৃপক্ষকে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এক নম্বর দাবি ছিলÑ আবরার ফাহাদ হত্যায় গ্রেফতার সবাইকে সাময়িক এবং অভিযোগপত্রে যাদের নাম আসবে, তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই মর্মে নোটিস দেবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটি নোটিস দিয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, ‘গত ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র আবরার ফাহাদের অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক হত্যা ঘটনার মামলার এজাহারভুক্ত ১৯ জনকে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। চলমান তদন্ত শেষে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের পর ডিসিপ্লিনারি বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিন্ডিকেটের অনুমোদনের মাধ্যমে দোষীদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে। এ ছাড়া আদালতের বিচারে এই মামলায় অন্য কেউ সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকেও স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে।’

শিক্ষার্থীদের দুই নম্বর দাবি ছিলÑ আবরার হত্যা মামলার সম্পূর্ণ খরচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে এবং আবরারের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকবে এবং সেটা নোটিসে লেখা থাকতে হবে। এ বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষের নোটিসে বলা হয়েছে, ‘আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা চলাকালীন সব খরচ বুয়েট প্রশাসন বহন করবে এবং আবরার ফাহাদের পরিবারকে বুয়েট কর্তৃপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।’

আন্দোলনকারীদের তিন নম্বর দাবি ছিলÑ সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে হলে অবৈধভাবে সিট দখলকারী ছাত্রদের উৎখাত করতে হবে। সাংগঠনিক ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস রুম সিলগালা করতে হবে। সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পর ভবিষ্যতে কেউ যদি এ ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমে জড়ায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেবে তা বিস্তারিত লিখে নোটিস জারি করতে হবে। পরে তা অর্ডিন্যান্সে যুক্ত করা হবে, সে কথাও নোটিসে উল্লেখ থাকবে। এ ধরনের কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি কমিটি গঠন করতে হবে এবং কমিটির কথা নোটিসে উল্লেখ থাকতে হবে। কর্তৃপক্ষ এই দাবি পূরণ করেও একটি নোটিস দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছেÑ সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিষিদ্ধ করা হলো।

আন্দোলনকারীদের চার নম্বর দাবি ছিলÑ ওয়েবসাইটে একটি কমন প্ল্যাটফরম যুক্ত করতে হবে, যেখানে বুয়েটে আগে ঘটে যাওয়া সব ধরনের র‌্যাগিং এবং ভবিষ্যতে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ থাকবে। একটি কমিটি করতে হবে যারা অভিযোগ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেবে। কর্তৃপক্ষ এই দাবি পূরণ করেও একটি নোটিস দিয়েছে। তাতে লেখা আছেÑ ‘র‌্যাগের নামে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা-সংক্রান্ত অভিযোগ জমাদান ও প্রকাশের জন্য একটি ওয়েববেসড পোর্টাল তৈরি করা হবে। যাতে কোনো ছাত্র একটি ফর্মের মাধ্যমে তার অভিযোগ অনলাইনে জমা দিতে পারবে। অভিযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করে ডিসিপ্লিনারি কমিটির মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’

শিক্ষার্থীদের পাঁচ নম্বর ও শেষ দাবিটি ছিলÑ প্রত্যেক হলের বারান্দার দুই পাশে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে এবং সেটা মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমরা চাই না, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯তম ব্যাচে যেসব অনুজ আসবে তারা একটি অসুস্থ একাডেমিক কালচারের অংশ হোক। বুয়েট কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের এই দাবি পূরণ করেও একটি নোটিস দিয়েছে। এ ছাড়া হলের রাজনৈতিক কক্ষ অপসারণ করা হবে উল্লেখ করেও কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ সিলগালা করা হয়েছে। একই সঙ্গে শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের অফিস কক্ষটিও সিলগালা করা হয়েছে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস সিলগালা ও বহিরাগতদের হল ছাড়ার নির্দেশ : বুয়েটের অবৈধ শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস কক্ষ বন্ধ করে তা সিলগালা করার জন্য ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুয়েটের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অবৈধভাবে যারা আবাসিক হলের সিট দখল করে আছে, তাদের অতিসত্বর হলের সিট খালি করা, সাংগঠনিক ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিসরুম বন্ধ করে তা সিলগালা করার জন্য ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ব্যবস্থা নেবে। এরই মধ্যে ছাত্র সংগঠনের কয়েকটি অফিস সিলগালা করেছে কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ভবিষ্যতে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি করার কেউ চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিন লঙ্ঘনের দায়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে র‌্যাগিং বা ছাত্র নির্যাতনের অভিযোগ এলে তা ডিসিপ্লিনারি কমিটির মাধ্যমে দ্রুত বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

ছাত্রলীগ সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষ সিলগালা : বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি খন্দকার জামিউস সানী ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের কক্ষ এবং বুয়েট ছাত্রলীগের কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গতকাল দুপুরে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান তিনটি কক্ষ সিলগালা করে দেন। জানা গেছে, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানী বিশ্ববিদ্যালয়টির আহসান উল্লাহ হলের ৩২১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। আর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল শেরেবাংলা হলের ৩০১২ নম্বর কক্ষে থাকতেন। মেহেদী হাসান রাসেল আবরার হত্যাকা-ের অন্যতম নির্দেশদাতা। হত্যাকা-ের দিন তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। সিসিটিভির ফুটেজে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। আবরার হত্যাকা-ের দিন তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানি বলেন, সকালে রুমেই ছিলাম। স্যাররা এসে রুমটি সিলগালা করে দেন। আর আহসান উল্লাহ হলের ১২১ নম্বর কক্ষে হল ছাত্রলীগের অফিস ছিল। সেটাও সিলগালা করা হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব অছাত্রদের হল থেকে উচ্ছেদ চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close