তহিদুল ইসলাম
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর র্যাগিং
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক দিন ধরেই চলছে র্যাগিংয়ের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা। সাধারণত আবাসিক হলের গেস্টরুমে র্যাগিং চলে বলে এটা ‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’ বলেও পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়া রয়েছে টর্চার সেল। সিনিয়র শিক্ষার্থীরা নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর র্যাগিংয়ের নামে চালায় ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়া, আত্মহত্যা এবং মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। প্রধানত আবাসিক শিক্ষার্থীরাই র্যাগিংয়ের শিকার হন। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও সম্প্রতি বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের পর র্যাগিংয়ের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
দেশের ৪৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৫৮টি হলে ‘টর্চার সেল’ রয়েছে বলে জানা গেছে। এইসব টর্চার সেলে থাকে লাঠি, হকিস্টিক, চেইন, লোহার রড ছাড়াও ইলেকট্রিক শকের মতো ভয়ংকর নির্যাতন সামগ্রী। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার স্বার্থে এসব বিষয়ে তারা মুখ খোলেন না। ভবিষ্যতে ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে এই শর্তে কেউ টর্চার সেলের কথা প্রকাশ করে না।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে টর্চার সেল রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে র্যাগিং এক নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। রাজধানীতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার আর্থিক সচ্ছলতা থাকে না অধিকাংশই শিক্ষার্থীর। ফলে বাধ্য হয়ে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকেন তারা। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগান ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন। তারা গণরুমে থাকা নবীন শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। কোনো কারণে কর্মসূচিতে অনুপস্থিত হলে মারধর করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিচার সালিসের নামেও চলে মারধর। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুরকে খোলা জায়গায় সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এরপর নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মারধরের শিকার হয়ে চোখ হারাতে বসেন দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী দেশত্যাগ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং চলছে দুই দশক ধরে। আবাসিক হলের গেস্টরুম ছাড়াও বিভাগ, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেওয়া হয়। গেস্টরুমের পরিবর্তে গণরুমে গভীর রাতে নবীনদের র্যাগ দেওয়া হয়। তুচ্ছ কারণে মারধরের ঘটনাও ঘটে। সিনিয়রদের নানাবিধ অন্যায় নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করা হয় জুনিয়রদের। হলে শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখা, লুঙ্গি পরে চলাচল করা ও টিভিরুমে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন সিনিয়ররা। এর ব্যত্যয় হলে চলে অশ্রাব্য গালাগাল ও মারধর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং : প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ডেকে নিয়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। গালাগাল ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জানুয়ারি মাসে ফাহাদ বিন ইসমাঈল নামে ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের কারণে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। ঘটনাটি তখন ব্যাপক আলোচনায় আসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অন্তত ১৫টি চর্টার সেল রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঠুনকো অজুহাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। আর বড় কোনো ঘটনায় ব্যাপক মারধরের শিকার হতেন শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পেটানো হতো ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে। কখনো কখনো মিথ্যা অভিযোগ তুলেও মারধর করা হতো।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল না থাকায় র্যাগিংয়ের ধরণটা অন্যরকম। এখানে নবীন শিক্ষার্থীদের আগমনের পর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভাগগুলোতে পরিচিত হতে যান। সে সময় র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নবীনদের বিভিন্ন গ্রুপে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। এছাড়া বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোতেও চলে মানসিক নির্যাতনের ঘটনা। এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ে জড়িত থাকায় বহিষ্কৃৃত হয়েছেন অনেকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকারের ছাত্র সংগঠন একক আধিপত্য তৈরি করে। আধিপত্য ও ক্ষমতা চর্চার বহিঃপ্রকাশ হলো র্যাগিং। গত ১০ বছরে একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য আরো বেড়ে গেছে। ক্রমান্বয়ে র্যাগিং বাড়ছে।
তিনি বলেন, এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রথম বর্ষেই তাদের মেরুদন্ড ভেঙে দেওয়া, ব্যক্তিত্ব ভেঙে দেওয়া। এর মাধ্যমে চিন্তা ও বোধশক্তিহীন একটা অনুগত গোষ্ঠী তৈরি হয়। যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত না থাকে, স্বাধীন চিন্তা করার লোক না থাকে।
তিনি আরো বলেন, এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাখার দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে। এটা প্রথম এবং প্রধান শর্ত। সরকার যদি এই কাজটা করে বাকি কাজগুলো অটোমেটিক হবে।
"