নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ইসির সার্ভার সুরক্ষিত, ভুয়া ভোটার হওয়া যায় না : এনআইডি ডিজি

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল সার্ভার সুরক্ষিত। এখানে তথ্য গোপন কিংবা ভুয়া তথ্য সংযোজন করে ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই। গতকাল সোমবার ইসির সম্মেলন কক্ষে চলমান হালনাগাদ তালিকায় রোহিঙ্গা ভোটার নিবন্ধন হওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু বিভাগের (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অভিযোগ উঠেছে; এ কাজে সম্পৃক্ত এমন কর্মীর সংখ্যা ১৫ জনের বেশি নয়। এই অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এনআইডির ডিজি বলেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে জড়িতরা কেউ ছাড় পাবেন না। তিনি বলেন, অবৈধ পন্থায় রোহিঙ্গাদের যারা ভোটার করছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম গোপন রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে এনআইডির ডিজি বলেন, অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে

সরকারের যে সংস্থাই ব্যবস্থা নিতে চায়, আমরা তাদের স্বাগত জানাব। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করব। প্রয়োজনে সিআইডি ও এসবিরও সহায়তা নেওয়া হবে। এছাড়া কাউন্টার টেররিজম ইউনিট বিশেষভাবে নজরদারি চালাবে।

প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে ভোটার তথ্যে সার্ভারের প্রেজেনটেশন তুলে ধরে এনআইডি ডিজি বলেন, আমাদের মূল সার্ভার সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। অনেকেই না জেনে বলছেন, ইসির সার্ভারে রোহিঙ্গা ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ইসির মূল সার্ভারে কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। তারা চলমান ভোটার তালিকা হালনাগাদে রোহিঙ্গারা টেম্পোরারি সার্ভারে ঢুকেছে। তাদের ৬১ জনকে আমরা চিহ্নিত করেছি। এনআইডির মূল সার্ভারে কোনো অপরাধী প্রবেশ করতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলমান হালনাগাদ শেষে মূল সার্ভারে নতুন ভোটারদের তথ্য ইনপুট দেওয়ার আগে শুধু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা নয়, সারা দেশের ভোটারের তথ্য ক্রসমেচিং করা হবে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ডাটাবেস ক্রসমেচিংয়ে কাজে লাগানো হবে। যাতে বাংলাদেশি নাগরিকের বাইরে একজনও রোহিঙ্গা ভোটার না হতে পারেন। এমনকি পাসপোর্ট নিয়ে কোনো রোহিঙ্গা বিদেশে গিয়ে থাকলেও তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।

জড়িত চক্রকে চিহ্নিত করার ঘটনা তুলে ধরে এনআইডির ডিজি বলেন, আমরা ফাঁদ পেতে একটি চক্রকে ধরতে সক্ষম হয়েছি। সামরিক বাহিনীতে আমরা যেটা অ্যামবুশ বলি। এতে আমাদের ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের কর্মচারী জয়নালকে প্রথমে চিহ্নিত করা হয়। এরপর অন্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সংখ্যাটা ১৫ জনের বেশি হবে না। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দৃশ্যমান হবে বলেও তিনি জানান।

সাইদুল ইসলাম বলেন, যারা এই অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত তাদের বেশির ভাগই ইসির থেকে আগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। তারা ইসির বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতেন। আমরা এরই মধ্যে আমাদের সব উপজেলা কর্মকর্তা ও যারা আমাদের লোকবল সাপ্লাই দেন তাদের বলেছি আগে চাকরিচ্যুতরা যেন ভোটার তালিকার কাজে কোনোভাবে সম্পৃক্ত হতে না পারেন। এমনকি ওই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেখানে চাকরি করবেন তাদের ওপরেও নজরদারি চালানো হবে, যোগ করেন এনআইডির ডিজি।

‘জিরো টলারেন্স এগেইনস্ট করাপশন’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার এই নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে এনআইডির ডিজি বলেন, আমরা শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছি। ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা আগে যারা কাজ করেছেন তাদের কেউ জড়িত থাকেন সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার অপচেষ্টায় যেই জড়িত হোক না কেন আমরা সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব। ফৌজদারি মামলা কিংবা বিভাগীয় মামলাও করব। এছাড়া অন্য যেকোনো সংস্থার কেউ যদি জড়িত থাকেন তাদের বিরুদ্ধেও সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এনআইডি তথ্য ভান্ডার সুরক্ষিত রাখার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার আমরা সব পদক্ষেপ নেব।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এনআইডির ডিজি বলেন, প্রবাসে যখন আমরা ভোটার করব তখনও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামেও এরই মধ্যে যারা ভোটার হয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ রোহিঙ্গা আছেন কি না সেটাও দেখা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, আগামীতে কেউ যেন রোহিঙ্গাদের টেম্পরারি সার্ভারেও যুক্ত করতে না পারেন সেজন্য সব কর্মকর্তার পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে দিয়েছি। তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সার্ভারে ঢোকার জন্য ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) মেসেজের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে অন্তর্ভুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইসির এনআইডি অনু বিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল বাতেন বলেন, ৬১ জনের মধ্যে আমাদের বিশেষ তদন্ত কমিটি একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ইসির এক কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও তিনি জানান। আর এনআইডির ডিডি ইকবাল হোসেন বলেন, জয়নালের সহায়তা বিশেষ ফাঁদ পেতে অপরাধীদের ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ওবায়দুল একজন। জনপ্রতি ৪০ হাজার টাকা নিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তারা ভোটার করতেন।

এদিকে, দুদকের পক্ষ থেকে এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, জালিয়াতি, প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে বিতারিত রোহিঙ্গাদের এনআইডি দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ও পাবনায় কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান ও চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখ। লতিফ শেখ বর্তমানে পাবনার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় এনআইডি প্রজেক্টের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগর, একই শাখার সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে, চট্টগ্রামের পটিয়ার বড় উঠান ইউনিয়নের শাহানুর মিয়া, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী অপারেটর জনপ্রিয় বড়ুয়া ও চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন, মো. শাহিন, ফাহমিদা আকতার, পাভেল বড়ুয়া ও মো. জাহিদ।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয়পত্রের বিষয়ে তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ও জেলা ইসি কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক টিম। ইসির সার্ভারে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সংরক্ষিত থাকার প্রমাণ এবং এ ঘটনায় জনপ্রতিনিধিসহ ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর অভিযান চালায় দুদক। দুদক জানায়, সম্প্রতি লাকী ওরফে বিবি নামে এক রোহিঙ্গা নারী জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে এসে পুলিশের হাতে আটক হন। পরে তার স্মাটকার্ড পরীক্ষা করে ইসির সার্ভারে থাকা কোড নম্বরের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

দুদকের অভিযানের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করে। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শিমুল শর্মা বাদী হয়ে জেলা সদর থানায় ভোটার তালিকায় ৬০০ রোহিঙ্গার নাম উঠানোর অভিযোগে মামলা করেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম ইসির আঞ্চলিক কার্যালয় তাদের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করে। ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর লাভ লেনে অবস্থিত আঞ্চলিক সার্ভার স্টেশন থেকে গ্রেফতার হয় ইসির চার কর্মী। তারা হলেন অস্থায়ী কর্মী মো. শাহিন, ফাহমিদা আকতার, পাভেল বড়ুয়া ও মো. জাহিদ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close