নিজস্ব প্রতিবেদক ও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত

উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন ঘিরে অশান্ত হয়ে উঠেছে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। শুরুটা এক ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে। পরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের চতুর্থ দিন গতকাল শনিবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। পদত্যাগ করেছেন সহকারী প্রক্টর মো. হুমায়ুন কবির। এদিকে, এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গতকালই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসাইনকে এ নির্দেশ দেন উপমন্ত্রী।

তবে চলমান সংকটের সমাধান না করে বশেমুরবিপ্রবি বন্ধ ঘোষণা করার ঘটনাকে যেকোনো উপায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের কৌশল হিসেবে দেখছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে বসার তিন দিন পার হলেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। দায়িত্বশীল কেউ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায়ও বসেননি। শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা কোনোভাবেই বিদ্যমান সংকটের সমাধান হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান বলেন, বেশ কয়েক দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের নেতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি অনভিপ্রেত। মূল সমস্যা সমাধান না করে বন্ধ করে দেওয়া সমাধান না উল্লেখ করে আবদুল মান্নান আরো বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো একদিন খুলতেই হবে। বিষয়টি প্রশাসনের সমাধান করা উচিত। ছাত্রীকে বহিষ্কারের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বিষয়টি উপাচার্যের সমাধান করা উচিত ছিল। আমরা তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি, সেখানে কিছু লুকাতে পারবেন না। তিনি যে ভাষায় কথা বলেন, সেটি শিক্ষকসুলভ নয়। আহমদ ছফার মতোই বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে রাষ্ট্র থমকে দাঁড়ায়। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাতদের ঢুকিয়ে হামলা চালানোর নিন্দা জানান তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন মনে করেন এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বিরোধীপক্ষ ভাবার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি উদ্ভূত হতে পারে কিন্তু শিক্ষকদের উচিত তাদের জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরোধী অবস্থানে না গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা। কোনো রকম বহিরাগত বা পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঠেকানো সম্ভব নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদি রিপন বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গোপালগঞ্জের নবীনবাগ এলাকার মেসে থাকি। সেখান থেকে শনিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। পথে গোবরা সোবাহবান সড়কে আমাদের ওপর উপাচার্যের লোকজন লাঠি, রামদাসহ দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে আমাদের ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হন।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিল আহমেদ বলেন, আমাকে একদল গুন্ডা লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করলে দৌড়ে পানির মধ্যে চলে যাই। আমাদের আন্দোলন শুধুমাত্র উপাচার্যকে অপসারণের জন্য। অন্য কারো সঙ্গে নয়। তবে কেন আমাদের ওপর হামলা করা হলো?

শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ রোববার থেকে ১১ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নুরউদ্দিন স্বাক্ষরিত ওই আদেশে গতকাল সকাল ১০টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, হামলার জন্য উপাচার্যপন্থি শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের দায়ী করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আহতদের মধ্যে দেশ রূপান্তরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শাফিউল কায়েস, বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সদস্য তাওহিদ ইসলাম ও আল মুরাদ রয়েছেন।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের বেলা ১১টা পর্যন্ত হল থেকে বের হতে দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে যোগ দেন শিক্ষার্থীরা। তাদের একটাই দাবি ভিসির অপসারণ। টানা চার দিন আন্দোলন এবং তিন দিনের আমরণ অনশন কর্মসূচি চলে তাদের। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে যুক্ত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

এই অবস্থায় বশেমুরবিপ্রবি সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন মো. হুমায়ুন কবির। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অনৈতিক কার্যকলাপের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে সহকারী প্রক্টর পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ভিসির অনৈতিক কাজের প্রতিবাদে আমি পদত্যাগ করেছি। ভিসির ইন্ধনে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা করেছে, তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

এর আগে শুক্রবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনকে বিএনপি-জামায়াতের লোক বলেও আখ্যায়িত করেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে দাবি করে, তার পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। আর গত বুধবার রাত ১২টার দিকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে সেগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান।

গত ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা আন্দোলন শুরু করেন। ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া ডেইলি সান পত্রিকার প্রতিনিধি। সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে গত বুধবার জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তারা রাত সাড়ে ৯টায় হল থেকে বের হয়ে আন্দোলন শুরু করে।

ঢাবি ও বশেমুরবিপ্রবিতে হামলার প্রতিবাদে জাবিতে বিক্ষোভ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে শেষ হয়।

সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম পাপ্পু বলেন, বাংলাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা স্বৈরাচারী অবস্থান গ্রহণ করছেন। এর কারণ হলো দলবাজি করে তারা ক্ষমতায় এসেছেন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা স্বৈরাচারী আচরণ করা শুরু করছেন।’

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের জাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আদিব আরিফের সঞ্চালনায় এ সময় অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের জাবি শাখার আহ্বায়ক শাকিল উজ্জামান, ছাত্রফ্রন্টের (মার্কসবাদী) সভাপতি মাহাথির মহাম্মদ, ছাত্রফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক শোভন রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সদস্য রাকিবুল রনি প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close