সংসদ প্রতিবেদক

  ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী

প্রতিহিংসার রাজনীতি করলে বিএনপির অস্তিত্ব থাকত না

বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দুঃশাসন এবং আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাস ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষ হত্যার রাজনীতি করে না, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসীও নয়। সেটা বিশ্বাস করলে এদেশে বিএনপির অস্তিত্ব থাকত না। সংসদ নেতা বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যার অন্যতম কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কাজের সমন্বয় করা। মন্ত্রীদের কাজের তদারকি করা। জনগণ তাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য। আরাম-আয়েসের জন্য নয়। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এদিন সংসদের বৈঠকে সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্যের লিখিত ও সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার প্রশ্নের লিখিত জবাবে শেখ হাসিনা আরো বলেন, বিএনপি সরকারের সময় তাদের হাতে আওয়ামী লীগ যে পরিমাণ হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে তা আর কেউ হয়নি। এদেশে জঙ্গি সৃষ্টি, অগ্নিসন্ত্রাস, বোমা হামলা, মানিলন্ডারিং, এতিমের টাকা আত্মসাৎসহ হেন অপকর্ম নেই যে খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে এবং তার দলের নেতারা করেননি।

এর আগে রুমিন ফারাহানার প্রশ্ন ছিলÑ ‘দেশে বর্তমানে মানুষ হত্যা হতে মশা মারা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রয়োজন হয়।’ এমন প্রশ্নের তীব্র সমালোচনা করে লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (রুমিন) একটি অনাকাক্সিক্ষত, অসংসদীয় ও অবান্তর প্রশ্ন এনেছেন। তিনি মানুষ হত্যা আর মশা মারাকে একই সমতলে নিয়ে এসেছেন। সংসদ সদস্যের নেত্রী খালেদা জিয়ার মতো দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটালেই কি প্রশ্নকারী খুশি হতেন?

তিনি বলেন, রাষ্ট্র একটি যন্ত্রের মতো। এই যন্ত্রের বিভিন্ন কল-কবজা যখন সমন্বিতভাবে কাজ করে তখনই রাষ্ট্র ভালো থাকে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র ভালোভাবে কাজ করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিষ্ঠানের অকার্যকর হওয়ার কথা উনি (রুমিন) বলছেন। অকার্যকর রাষ্ট্রের উদাহরণ তো বিএনপিই সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসত রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তির কাছ থেকে। প্রধানমন্ত্রী ঘুমিয়ে থাকতেন, সিদ্ধান্ত দিতেন তার পুত্র হাওয়া ভবন থেকে। মন্ত্রী-সচিবরা হাওয়া ভবন থেকে নির্দেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনতেন।

তিনি বলেন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। যিনি তার জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। তার মেয়ে হিসেবে জনগণের প্রতি তার (শেখ হাসিনা) দায়বদ্ধতার একটা আলাদা জায়গা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেটাই প্রতিপালনের চেষ্টা করি। সেজন্য দিনরাত পরিশ্রম করি। কোনো প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করার জন্য নয়, সব প্রতিষ্ঠানকে আরো সক্রিয় রাখার জন্য সদা-সর্বদা সচেষ্ট থাকি।

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা এবং জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকে বাংলাদেশ বিশ্বে একটা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বসেরার জায়গায় দখল করেছে। এসব আপনা আপনি হয়নি। সবার পরিশ্রমে হয়েছে। প্রতিষ্ঠান অকার্যকর থাকলে এসব অর্জন সম্ভব হতো না।

সংসদ নেতা বলেন, প্রশ্নকর্তা বিএনপি এমপির দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হয়ে খুনিদের সহায়তায় ক্ষমতায় বসেছিলেন। জিয়াউর রহমানের প্রতিহিংসার বলি হয়ে জেলখানায় নির্মমভাবে নিহত হন জাতীয় চার নেতা। জিয়াউর রহমানই তো এ দেশে হত্যা, ক্যুর অপরাজনীতি শুরু করে। সশস্ত্র বাহিনীর শত শত অফিসার, সৈনিককে হত্যা করে। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটের সংস্কৃতি চালু করে। একটা পুরো প্রজন্মকে নষ্ট করে দেয় এই মেজর জিয়া। তাই বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্যের মুখে মানুষ মারার বিষয়টি অবলীলায় চলে আসে। এটাই তো তাদের দলীয় আদর্শ। আর জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া যে তার (জিয়া) চেয়েও এক কাঠি সরেস সে প্রমাণ তিনি করেছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রশ্নকর্তার নেত্রী খালেদা জিয়াও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার শাসনামলের ৫ বছরে আওয়ামী লীগের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকেসহ আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্বকে নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মদদে খুনের নেশায় মত্ত হয়েছিল তার দল বিএনপি।

তিনি বলেন, দেশবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ২০১৪ সালের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসের কথা। প্রশ্নকারী বিএনপি এমপির দল বিএনপি নারী ও শিশুসহ ৫০০ নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। নির্মমভাবে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৪ সদস্যকে। ৫৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩ হাজার যানবাহন, ২৯টি রেল, ৯টি লঞ্চ এবং ৭০টি সরকারি অফিসে অগ্নিসংযোগ করেছে। অসংখ্য বৃক্ষ নিধনসহ গবাদিপশু আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি শিশু ও মহিলারাও।

গণফোরামের সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ যখন আমাকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়েছে এবং আমি যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছি তখন আমি মনে করি মানুষের ভালো মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব। খালেদা জিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেশ চালাই না। বেলা ১২টা পর্যন্ত তো ঘুমাই না। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ৫ ঘণ্টা ঘুমাই। বাকি সময় দেশের কোথায় কী হচ্ছে খোঁজ রাখার চেষ্টা করি এবং তার সমাধান করি। তবে সব কিছু আমাকেই দেখতে হবে তা নয়।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ১ লাখ ৫৭ হাজার এসএস-ওয়ান কম্ব কিটসহ ৩ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণ কিট আমদানি করেছি। গত ৬ আগস্ট থেকে বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে দেশেই ডেঙ্গু রোগের কিট তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর ফলে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ হাজার কিট সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ডেঙ্গু রোগ শনাক্তকরণ কিট ঘাটতির কোনো সম্ভাবনা নেই।

দেশবাসীকে ডেঙ্গু রোগ মোকাবিলায় নিজ নিজ এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বে বিশেষ করে উষ্ণম-লীয় ১২৭টি দেশে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার চিকিৎসা গাইড লাইন রয়েছে। এই গাইড লাইনের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়েছে। তারা স্থানীয় চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ এবং ডেঙ্গুজ¦রের চিকিৎসার জন্য দেশের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগ ৬৪ জেলায় মনিটরিং টিম গঠন করেছে। এ মনিটরিং টিম জেলা পর্যায়ে জনসতেনতা সৃষ্টি, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে উৎসাহিত করা, সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিশ্চিতকল্পে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী ১৭ মার্চ ২০২০ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষ’ এর আয়োজন তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলাই তার সরকারের মূল লক্ষ্য। নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, দেশের জন্য কী করতে পারলাম সেটাই আমার কাছে মূল লক্ষ্য। বিশ্ব নেতা জাতির পিতা, আমি নই। এটা আমার বিনয় নয়, এটাই বাস্তব সত্য কথা।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, যেকোনো চুক্তি সম্পাদনের সময় বাংলাদেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখেই খসড়া প্রস্তুত ও চূড়ান্ত করা হয়। তিস্তাসহ অন্য সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। এ চুক্তিটি সম্পাদনের জন্য সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এসব বিষয় ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে ভালোভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

তিনি জানান, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে অদ্যাবধি চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের সংশ্লিষ্ট রাজ্যে সরকারের সহযোগিতায় তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ভারত সফরের সময়ে আমি তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা সমাধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি সমাধানে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আগামী মাসে (অক্টোবর) ভারত সফরের সময়েও আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয় আলোচনা করব। আশা করা যায়, এ ব্যাপারে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য রুমানা আলীর প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের চাপে মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করলেও তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট গড়িমসি করে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী পরিচিতি যাচাইয়ের জন্য মিয়ানমারের কাছে আমরা এ পর্যন্ত ৩ দফায় ৫৫ হাজার ৫১১ জন রোহিঙ্গার তথ্য প্রদান করেছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close