নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ আগস্ট, ২০১৯

‘এখনো বিকট শব্দে আঁতকে উঠি’

‘সেই ভয়ংকর শব্দ এখনো কানে বাজে। ভয়ে থর থর করে কাঁপি। ঘুমও আসে না; যদিওবা আসে স্বপ্নের মধ্যে দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে ফিরি, আঁতকে উঠি। এই ঝুঝি আবার জনতার পায়ের নিচে পিষে যাই।’ এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার শব্দে ভয় পেয়ে দৌড়াতে গিয়ে জনতার পায়ের নিচে পড়ে আহত তৎকালীন সাপ্তাহিক এশিয়া বার্তার সাংবাদিক কাইয়ুম আহমেদ। বর্তমানে তিনি প্রতিদিনের সংবাদের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক।

এই প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলার সময় ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। বলেন, আগে নিজের ব্যথা নিয়ে না ভাবলেও এখন দুই ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের ভাবনায় কাতর। এক রকম পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছি। ঘাড়, পিঠ, হাড়, কোমর ও হাঁটুর যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। চিকিৎসকরা বলছেন, আমি আর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারব না। বরং ধীরে ধীরে আরো খারাপের দিকে যাব।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় কাইয়ুম বলেন, ‘হামলার সময় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়াতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মূল সড়কে (নবাবপুরের দিকের রাস্তা) পড়ে যাই। আমার ওপর দিয়ে মানুষ ছুটে গেলে কোমরে ও মেরুদ-ে আঘাত পাই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করি। কিন্তু ব্যথার উপশম হয়নি। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দৈনিক যায়যায়দিনে কর্মরত অবস্থায় মেরুদ-ে ব্যথার কারণে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হই। কয়েক দিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও কোমর ও মেরুদ-ে ব্যথা বাড়তেই থাকে। পরে দুই দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্পাইনাল কর্ড ও লিভারে সমস্যা ধরা পড়ে। এরপর থেকে নিয়মিত ওষুধ খেয়ে এবং ফিজিওথেরাপি নিয়েও ব্যথা থেকে রেহাই পাইনি। এখনো সেই ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছি।’

কাইয়ুম আরো বলেন, ‘সেদিন মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসায় হয়তো নতুন জীবন পেয়েছিÑ কিন্তু যত দিন তারা বেঁচে থাকব তত দিন বহন করে যেতে হবে সেই শব্দের ভয়াবহতা, যা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। রাতে ঘুমাতে পারি না। ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েও মাঝে মাঝে ঘুম আসে না। রাতে চিৎকার করে করে উঠি। সেই শব্দ। সেই ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকি। সেই ভয়ংকর শব্দ এখনো কান থেকে যায় না। মাথায় শব্দ ভর করে আছে। কঠিন যন্ত্রণা ভোগ করছি।’

রাজধানীর খিলগাঁও থানার দক্ষিণ বনশ্রীতে ভাড়াবাসায় এভাবেই নিজের ভয়াল স্মৃতিচারণ করছিলেন সাংবাদিক কাইয়ুম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সমাবেশ স্থলে ট্রাকের পূর্ব পাশে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে (আওয়ামী লীগ অফিসের রাস্তার মুখে) ছিলাম। শেখ হাসিনা বক্তব্যের শেষ দিকে জয় বাংলা স্লোগান দিলেন, ঠিক তখনই বিকট শব্দ। ভয়ে আতঙ্কে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যাই। জনতার ঢল ছুটছে সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি। কখন যেন জনতার পায়ের নিচে পড়ে যাই। চিৎকার করলেও কে শোনে কার কথা সবাই দিগি¦দিক। পরে অনেক কষ্টে উঠে আবার দৌড়াই। পরে বাসায় গিয়ে ব্যথায় ছটফট করি।’

জানা গেছে, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং সাভারের সিআরপিতে বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সর্বশেষ চলতি মাসে এমআরআই রিপোর্টে ঘাড়, মেরুদ- এবং হাঁটুতে সমস্যা ধরা পড়ে। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোজাফ্ফর আহমেদের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অসটোসিস কলার ও স্ক্র্যাচে ভর করে হাঁটা, ওষুধ সেবন ও থেরাপি নিয়ে চলতে হচ্ছে। এরই মধ্যে চোখের দৃষ্টি শক্তিও কমে গেছে। শরীরে প্রচ- ব্যথা নিয়েই নিয়মিত অফিস করছেন। তবে চিকিৎসা ব্যয় বহনে জন্য পর্যাপ্ত টাকাও নেই তার। ধারকর্জ করে কোনো রকম চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিকিৎসা করাতে আরো তিন থেকে চার লাখ টাকার প্রয়োজন। তবু বাকি জীবন ব্যথামুক্ত পার করা সম্ভব নয়। এই বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা ব্যয় মেটানো কাইয়ুম ও তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত কাইয়ুম একসময় আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সাবেক ৭৪নং ওয়ার্ড (বর্তমান ডিএসসিসির ৩৮নং ওয়ার্ড) আওয়ামী লীগের একটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close