নিজস্ব প্রতিবেদক
পরিস্থিতি মোকাবিলায় ৭ দিন চ্যালেঞ্জিং
জুলাই মাসের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও গত কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির হার কমেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দিন ধরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৬০ জন ডেঙ্গু নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭২১ জন; তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ১ হাজার ৯৩৩ জন। এছাড়া ঢাকার হাসপাতালগুলো থেকে ৬০৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭১৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এদিকে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে এক শিশু মারা গেছে। তারা হলেন কলেজছাত্র মোল্লা (১৭), মনোয়ারা বেগম (৪৫) ও আয়াজুর রহমান (৬ মাস)। এ নিয়ে সরকার চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪২ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী সাত দিনকে চ্যালেঞ্জিং বলেছেন সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা। গতকাল নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘আগামী সাতটা দিন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে নয়। আমরা যদি এডিসের দুর্গে আঘাত হানতে না পারি তাহলে পরিস্থিতি কী হবে বলা মুশকিল।’
এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদও বলেছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোনো দিকে যাবে তা বুঝতে সপ্তাহ খানিক সময় লাগবে। গতকাল শনিবার বিকালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বুঝতে আমাদের আরো এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আমাদের এখন উচিত নিজেদের এডিস মশা থেকে দূরে রাখার সব পন্থা অবলম্বন করা।’
ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে মশক নিরোধক আমদানির ওপরও জোর দিয়েছেন আবুল কালাম আজাদ, ‘নিজেদের রক্ষা করার জন্য যেমন ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা জামা পরিধান করা দরকার, তেমনি রিপেল্যান্ট দ্রুত আমদানি করা যায় কি না সে বিষয়েও জোর দেওয়া দরকার।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫১ হাজার ৪৭৬ জন। আগস্টের মাঝামাঝিতে পুরো জুলাই মাসের দ্বিগুণের বেশি রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এরপর আগস্টে তা আরো বাড়ে। তবে আগস্ট ডেঙ্গুর মৌসুম হলেও মশা নিধনে নানা তৎপরতায় পরিস্থিতির উন্নতি আশা করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার।
তিনি বলেন, মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। এসব কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।
তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত যে ১ হাজার ৪৬০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তার মধ্যে ঢাকায় ৬২১ জন এবং ঢাকার বাইরে ৮৩৯ জন। আর গতকাল দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭ হাজার ৮৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৪৩ জন, ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ৮১৩ জন। রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ২১৯ জন নতুন রোগী ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়া চট্টগ্রামে ১৭০, খুলনা বিভাগে ১০৯, রংপুর বিভাগে ৪৯, রাজশাহী বিভাগে ১০৫, বরিশাল বিভাগে ১৩৮, সিলেট বিভাগে ১৩, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৪ জন ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু নিয়ে।
ঢাকা : ঢাকা মেডিকেল মারা যাওয়া মনোয়ারা বেগমের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে। তার স্বামীর নাম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরেই মনোয়ারার জ্বর ছিল। স্থানীয় ভাগলপুর হাসপাতালে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার সময় অবস্থার অবনতি হলে গত মঙ্গলবার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিৎসারত অবস্থায় গতকাল সকালে তিনি মারা যান।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, মনোয়ারার স্বজনরা বলেছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। পরিবারের সদস্যরা লাশ নিয়ে গেছেন।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডাক্তার শাহিন শরীফ শিশুটির মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করে জানান, আয়াজুর রহমানকে ১৪ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১১ শিশুর মৃত্যু হলো এই হাসপাতালে।
ফরিদপুর : ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মাগুরার এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান বুলু জানান, শনিবার সকালে সুমন মোল্লা (১৭) নামে এই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। সুমন মাগুরা সদর উপজেলার ধলহরা চাঁদপুর গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে। সে স্থানীয় শত্রুজিৎপুর কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল।
চিকিৎসক মোস্তাফিজুর বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সুমনকে ১২ আগস্ট বিকালে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার ব্রেইনে সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। আমরা তাকে সুস্থ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এর আগে তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
এ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক স্বপন কুমার কু- বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সুমনকে ৮ আগস্ট আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলা হয়েছিল।
বাড়িতে থাকার সময় সুমনের জ্বর হলে তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বলে তার চাচা গফ্ফার মোল্লা মধু জানান। তিনি বলেন, পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন চিকিৎসক। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে তার মৃত্যু হয়।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, এখন ৩৩১ জন ভর্তি আছে। সুমন পৌনে ১০টায় মারা যায়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি রোগীদের সেবা দিতে।
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক জানান, গতকাল শনিবার ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ৩৯৬ জন, চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫৭০ জন, রেফার্ড করা হয়েছে ১৩০ জন। ২০ জুলাই থেকে ভর্তি হয়েছে ১১০০ জন আর মারা গেছেন ৪ জন।
মাগুরার স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, মাগুরা সদর হাসপাতাল ও মহম্মদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেড় শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে বর্তমানে ৩০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্যরা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন।
"