প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২২ জুলাই, ২০১৯

ছেলেধরা গুজবে ২১ গণপিটুনি : ৫ জনকে হত্যা

‘পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে শিশুদের মাথা লাগবে’ এমন গুজবে দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা ভেবে এলাকায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত শনিবার একই ঘটনা ঘটে ঢাকায়। ‘ঢাকায় নিহত নারীর উদ্দেশ্য ছিল তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করা’, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই গণপিটুনির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। তদন্ত করা হচ্ছে গণপিটুনির ইন্ধনদাতাদের শনাক্তে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। আহত ২২ জন।

গত শনিবার গণপিটুনিকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ উল্লেখ করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। যেকোনো মূল্যে এই বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে কাজ করছে তারা।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে একটি গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ।

তিনি আরো বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে এ পর্যন্ত যত নিহতের ঘটনা ঘটেছে পুলিশ প্রত্যেকটি ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে। গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার সকালে ছেলেধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ছয় জেলেকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার কুসম্বা ইউনিয়নের বুড়িদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লায় ৪ জনকে গণপিটুনি : কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পৃথক দুটি স্থানে ছেলে ধরা সন্দেহে রোববার সকালে গণপিটুনিতে চারজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করে।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের ধূতিয়া দীঘির পাড় এলাকায় আমড়াতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে রোববার বেলা সাড়ে ১০টায় একটি শিশুকে ডাক দেওয়ার ঘটনায় ছেলেধরা সন্দেহে গ্রামবাসী এক মহিলা ও দুই পুরুষকে ধরে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে কুমিল্লা আধুনিক হাসপাতালে প্রেরণ করে। আহতরা হলেন ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দুলালপুর ইউনিয়নের বেজোড়া গ্রামের রতœা বেগম (৫০), তার স্বামী আবুল কালাম ও একই গ্রামের জয়নাল আবেদিনের পুত্র আনোয়ার হোসেন (২৮)।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। শহরের শান্তিকুঞ্জ মোড়, সদর উপজেলার কান্দিলা ও কালিহাতি উপজেলার সয়া পালিমা গ্রামে পৃথক এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার বিভিন্ন সময় এই ঘটনা ঘটে। গণপিটুনির শিকার একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম আকাশ (৪২)। সে গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার মৃত আবদুর রহমানের ছেলে।

আদমদীঘি (বগুড়া) : বগুড়ার আদমদীঘির সান্তাহারে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিতে শুরু করলে পুলিশের উপস্থিতিতে সে প্রাণে বেঁচে যায়। গতকাল রোববার সকাল ১০টায় পৌর শহরের লকুকলোনি এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যক্তি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাজাপুর গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে আফজাল হোসেন (৪২)।

শনিবার রাজশাহীর তানোরে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক স্থানে দুই যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। ওইদিন বিকালে উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহাড়া ও কামারগাঁ ইউনিয়নের কচুয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রোববার সকালে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে।

শনিবার রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। রাত ৮টার দিকে গৌরীপুর ইউনিয়নের হিম্মতনগর বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে রাসেল মিয়া (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। আটক রাসেলের দাবি তিনি ফুল ব্যবসায়ী। রাত সাড়ে ৯টায় ফতুল্লার শিহারচর লালখাঁ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এদিন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ২ ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে একজন যুবক নিহত ও আরেক নারী আহত হন। তবে তাদের গণপিটুনির পরও তারা ছেলেধরা কি না সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

একই দিন ভোরে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করতে গিয়ে অভিভাবকদের গণপিটুনির শিকার হন রেনু নামে এক নারী। তার চার বছর বয়সি মেয়েকে স্কুলে দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। সন্দেহজনক আচরণের কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

একই দিন সাভারের ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়াকে, পাবনায় এক যুবককে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এদিন সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এক শিশুকে বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

১৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় অপরিচিত হওয়ায় তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত ও ১১ জুলাই চাঁদপুরে মনু মিয়া (৪০) নামের একজনকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। পরে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে মনু মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি। চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়।

কেন এমন হচ্ছে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, ‘যেকোনো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে’ এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এগুলো যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন যে কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে সাধারণ মানুষ, তাদের সঙ্গে হিং¯্র আচরণ করে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস না থাকাও গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার একটি অন্যতম কারণ।

এ পরিস্থিতি উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের সব সময় সতর্ক আচরণ করতে হবে, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তৎপর থাকতে হবে। এছাড়া এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তাকে ধরে কমিটির কাছে এনে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিশুদের জানাতে হবে যাতে তারা অভিভাবককে না বলে কারো সঙ্গে কোথাও না যায়। টিভিতে, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close