প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২২ জুলাই, ২০১৯

কমছে পানি, দেখা দিচ্ছে রোগবালাই

বকশীগঞ্জে বন্যায় ৭ শিশুসহ ১০ জনের প্রাণহানি

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল রোববার জানিয়েছে, পদ্মা ও ঢাকার চারপাশের নদ-নদী ব্যতিরেকে দেশের সব নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও সুরমা নদীর পানি হ্রাস পাবে এবং পদ্মা-কুশিয়ারা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকবে। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে।

অপরদিকে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। এদিকে, বকশীগঞ্জে বন্যায় সাত শিশুসহ ১০ জন নিহত হয়েছে।

এদিকে, বগুড়ায় বাঙালি নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় আরো চারটি নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মাদারগঞ্জে বন্যার পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ। দেখা দিয়েছে রোগবালাই। কালুখালী উপজেলার ২ ইউনিয়নের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি এবং ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট :

বগুড়া : বগুড়ার সোনাতলায় বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো চার ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া প্রায় দেড় হাজার পরিবারের শিশুদের মাঝে রোববার শিশুখাদ্য (দুধ ও পাউরুটি) বিতরণ করা হয়।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ কাটাখালি নদীর বউবাজার এলাকায় বাঁধ ভেঙে সোনাতলায় বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এলাকার রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সোনাতলা পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের পুরোটাই বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, রোববার যমুনা নদীতে ৮৩ সেন্টিমিটার এবং বাঙালি নদীতে বিপৎসীমার ৫০ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা গেছে, বন্যার্তদের বিশুদ্ধ পানির জন্য ডুবে যাওয়া টিউবওয়েলগুলো উঁচুকরণের ব্যবস্থার পাশাপাশি নতুন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। বগুড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুজ্জামান জানান, গত এক সপ্তাহে ১ লাখ ৮৫০ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।

মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের মাদারগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও কমছে না বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ। এ সময় দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে নানা রোগবালাই। সেসঙ্গে দেখা দিয়েছে খাদ্য, নিরাপদ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। ত্রাণের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। নৌকা দেখলেই মানুষ ছুটে আসছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

বন্যাকবলিত এলাকায় কিছু কিছু ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, টিউবওয়েল ও পায়খানা পানির নিচে। পাকা ও কাঁচা রাস্তাসহ জামালপুর-মাদারগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের অনেকাংশ ধসে গেছে। ব্যাহত হচ্ছে এলাকার সড়ক যোগাযোগ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও ওষধের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। পানি নেমে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িতে সহসাই ফিরতে পাচ্ছে না বাসিন্দারা।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনায় বন্যার পানি ২২ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। এখনো বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো বন্যাকবলিত এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম।

গতকাল বিকালে সাবেক মন্ত্রী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ আব্দুল লতিফ বিশ্বাস বন্যাকবলিত বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর, শাহাজাদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় এবং জেলা পরিষদের সহায়তা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।

পরিদর্শনকালীন তার সঙ্গে ছিলেন জেলা পরিষদের অন্যতম সদস্য প্যানেল চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল হামিদ আকন্দ, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য লুৎফর রহমান মাখন, বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের ভাইস চেয়ারম্যান, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সহযোগী অঙ্গসংগঠন নেতৃবৃন্দ। ইতোমধ্যেই জেলা পরিষদের সভায় বানভাসি মানুষের মাঝে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২৫ লাখ টাকা অনুদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

গতকাল সদর উপজেলার পক্ষ হতে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বানভাসি ৩৫০ মানুষের মাঝে চাল, ডাল, তেল, চিনি ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়। বিতরণকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না বানভাসি মানুষের খোঁজখবর নেন।

ফরিদপুর : গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি দুই সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হচ্ছে ফরিদপুর সদর উপজেলার বন্যাকবলিত পাঁচ ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা।

রোববার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের এক হাজার পরিবারের মধ্যে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির প্রকল্পের আওতায় পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। সকাল থেকে ট্রলারে করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে এসব চাল বিতরণ করা হয়।

পাংশা (রাজবাড়ী) : পদ্মায় পানি বৃদ্ধির কারণে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতন এবং কালীকাপুর ইউনিয়নের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বন্যায় রতনদিয়া ইউনিয়নের ১৮ গ্রাম এবং কালীকাপুর ইউনিয়ের নারায়ণপুর গতমপুর গ্রাম ডুবে গেছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদীর বাঁধ ভাঙা পানি এখনো নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গাইবান্ধা ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা এবং ৪৯টি ইউনিয়নের ৩৮৩টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩২৮ জন। ৪৪ হাজার ৭৯২টি বসতবাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭৪ হাজার ১০৪ জন অসহায় মানুষ আশ্রয় নিয়ে আছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ১৫০ টন চাল, ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেছে। সেগুলো দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণের কাজ চলছে।

গিদারী ইউনিয়নের গোরাইন গ্রামে বন্যার্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী (খাবারের কার্টন, পানি বিশুদ্ধীকরণ ট্যাবলেট ও জ্যারিকেন) বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন।

মৌলভীবাজার : প্রায় দুই যুগ থেকে কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা এলাকায় একই স্থানে ভাঙছে বাঁধ। কিন্তু বাঁধটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ হচ্ছে না। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহান। এমনটাই জানালেন এলাকাবাসী।

বানভাসিরা জানায়, পরিবারকে তাদের খুব কষ্টে দিন কাটছে। রান্না করার জায়গা নেই, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি নিয়ে তারা পড়েছে মহাবিপদে। এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা তারা পায়নি। বন্যার নোংরা পানির কারণে বাচ্চাদের বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। অচিরেই সংশ্লিষ্টদের কাছে সাহায্যের আবেদন তাদের।

কুশিয়ারায় ধীরে ধীরে পানি কমছে। কিন্তু রেখে গেছে ধ্বংসচিহ্ন। গ্রামগুলোর প্রায় ১০-১৫ হাজার বাসিন্দা সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। ঘরবাড়ি ছেড়ে তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছে।

বকশীগঞ্জে বন্যায় সাত শিশুসহ ১০ জন নিহত

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানায়, জামালপুরের বকশীগঞ্জে গত পাঁচ দিনে বন্যায় পানিতে ডুবে এখন পর্যন্ত সাত শিশুসহ ৯ জন মারা গেছে। এছাড়া সাপের দংশনে একজন নিহত হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার মেরুরচর ইউনিয়নের জাগিরপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে মাসুদ মিয়ার ছেলে মিনহাজ উদ্দিন (৫) মারা যায়। একই দিন সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বটতলা গ্রামের ফারুক মিয়ার মাদ্রাসা পড়–য়া ছেলে মাজ্জাদ হোসেন (১১) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হলে একদিন পর তার লাশ ভেসে উঠে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সাধুরপাড়া ইউনিয়নের উত্তর ধাতুয়া কান্দা গ্রামের শহীরুদ্দিনের শিশু কন্যা শরীফা আক্তার (৫) পানিতে ডুবে মারা যায়।

গত শুক্রবার সকালে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে আবু বক্কর (৫৫) নামে এক ব্যক্তি মারা গেছে। তার বাড়ি বগারচর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। একই দিন বিকালে বন্যার পানিতে শাকিব খান (৫) নামে এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের আইরমারী খান পাড়া গ্রামের রাশেদ খানের ছেলে।

গত শুক্রবার মেরুরচর ইউনিয়নের ঘুঘরাকান্দি ব্রিজের নিচে বন্ধুদের সঙ্গে গোসল করতে গিয়ে প্রবল শ্রোতে ভেসে যায় সুজন মিয়া (২৫) নামে এক পান ব্যবসায়ী। এরপর বন্ধুরা ও স্থানীয়রা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পায়নি। পরে গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার মাইছানিরচর এলাকায় তার লাশ ভেসে উঠে। সুজন মিয়ার বাড়ি বকশীগঞ্জ পৌর এলাকার চর কাউরিয়া সীমারপাড় গ্রামে।

শনিবার বেলা ১১টায় নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কুশলনগর গ্রামে খেলতে গিয়ে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রাহাত মিয়া (১০) নামে এক শিশু বন্যার পানিতে পড়ে মারা যায়। সে ওই গ্রামের হামিদুল ইসলামের ছেলে। একই দিন দুপুর ১২টায় বকশীগঞ্জ ইউনিয়নের ঝালুরচর পশ্চিমপাড়া গ্রামের রাজা বাদশা (৫৫) নামে এক ব্যক্তি সাপের দংশনে মারা যায়। বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সূর্যনগর পূর্ব পাড়ায় বন্যার পানিতে ভেলায় খেলতে গিয়ে ডুবে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, রোববার দুপুরে সূর্যনগর পূর্ব পাড়া গ্রামের শাহীন মিয়ার শিশু কন্যা সুজুনী আক্তার (১১), একই গ্রামের সোলায়মান হোসেনের কন্যা সাথী আক্তার (৮) ও মাসুদ মিয়ার কন্যা মৌসুমী আক্তার (৮) বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে ভেলায় করে খেলতে যায়। হঠাৎ ভেলাটি উল্টে পানিতে পড়ে গেলে ডুবে সুজুনী আক্তার ও সাথী আক্তার মারা যায়। এ সময় পানিতে হাবুডুবু খেয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মৌসুমী আক্তার।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close