প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২০ জুলাই, ২০১৯

কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে ৮৮-এর রেকর্ড ভঙ্গ

হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি

রানীনগরের বেড়িবাঁধ ভেঙে তিন গ্রাম প্লাবিত এবং শেরপুর ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে বন্যার রেকর্ড ১৯৮৮ সালের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

রানীনগর (নওগাঁ) : গতকাল শুক্রবার ভোরে নওগাঁর রানীনগরের ছোট যমুনার পাড়ের নান্দাইবাড়ী-মালি বেড়িবাঁধটি ভেঙে ওই এলাকার তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আগে থেকেই পানির চাপে বেড়িবাঁধের কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এলাকাবাসীকে নিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। খবর পেয়ে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা, রানীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নওগাঁ পাউবোর নির্বাহী কর্মকর্তা শুধাংসু কুমার সরকার বলেন, ভেঙে যাওয়া বাঁধটি লোকালি করা হয়েছে। এটি আমাদের আওতায় না, তার পরেও মানবিক কারণে সংস্কার করতে সহায়তা করছি।

শেরপুর : পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের পোড়ার দোকান এলাকায় কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে প্রবলবেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে শুক্রবার সকাল থেকেই এই সড়কে শেরপুর থেকে জামালপুর হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে দুই মিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা ছুইঁ ছুঁই করছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরাতন ভাঙন অংশ দিয়ে বন্যার পানি দ্রুতবেগে প্রবেশ করায় চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, শেরপুরের পাঁচ উপজেলার ৩৫ ইউনিয়নের ১৭২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত পাঁচ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান। (সকাল ১০টার তথ্য অনুযায়ী)। কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালি ও সদর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, চৌহালী উপজেলায় যমুনার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা, খোকসাবাড়ী, ছোনগাছা, কালিয়াহরিপুর, সয়দাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ২ সহস্রাধিক বানভাসী মানুষের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়। জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য এখনো ৪৪৪ মেট্রিক টন চাল, ৩ লাখ টাকা, ৫০০ তাঁবু মজুদ আছে।

মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের মাদারগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও দুর্ভোগ কমছে না। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৬৬ সেন্টিমিটার থেকে হ্রাস পেয়ে ১৬৪ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এবার যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি শত বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে জানিয়েছে জামালপুর পাউবো। এর আগে ২০১৭ সালে এ পয়েন্টে সর্বোচ্চ বন্যার পানি বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার এবং ১৯৮৮ সালে ১২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল।

চলতি বন্যায় প্লাবিত হয়েছে উপজেলার সাত ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা। এতে করে প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সরকারি অপ্রতুল ত্রাণে দুর্গতদের সংকট কাটছে না।

কুড়িগ্রাম : রাত ৩টায় হঠাৎ পানির কলকল শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রবিদাস-শ্যামলী দম্পতির। জেগে দেখেন ঘরের ভেতর বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। তাড়াহুড়া করে বিছানাপত্রসহ বাড়ির পাশের উঁচু সড়কে গিয়ে উঠেন, সেখানেই বাকি রাত কাটান। কিন্তু দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই দেখেন ঘর পেরিয়ে বানের পানি সেই সড়কেও হানা দিয়েছে, তাদের বিছানায় ছুঁই ছুঁই পানি। চুলা ভিজে যাওয়ায় সকালের রান্নাটুকুও সেরে নিতে পারেননি শ্যামলী, অ্যাজমা রোগী ষাটোর্ধ্ব রবিদাসের মুখে তাই বেলা ১১টাতেও কোনো খাবার জোটেনি। শ্যামলী বলেন, ‘রাইতে হঠাৎ ঘরত পানি, সড়কত উঠছি, এটিইয়ো পানি। কই যায়া আশ্রয় নিই!’

ঘরের ভেতর কোমর সমান উচ্চতায় পানি থাকায় রান্না করতে পারছেন না উপজেলার বালাবাড়ী এলাকাসংলগ্ন পানফুল বেওয়া, বিবিজান বেওয়াসহ রমনা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া কয়েকটি পরিবার। তাদের পানিবন্দি অবস্থার ছবি তুলতে গেলে পানফুল বেওয়া বাধা দিয়ে বলেন, ‘ছবি তুলি কী করবেন বাহে, হামাক এখন শুকনা খাবার দ্যাও।’ ত্রাণ সহায়তা পাননি বলেও জানান তিনি। জেলার ৯ উপজেলার প্রায় পৌনে ২ লাখ পরিবার এখন পানিবন্দি। চারপাশে শুকনা জায়গা নেই, ঘরে চাল থাকা সত্ত্বেও এরা রান্না করে খেতে পারছেন না। উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ ভাগ পরিবার পানিবন্দি।

এবারের বন্যা ’৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মত চিলমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী সরকার বীরবিক্রমের। তিনি বলেন, আমি দুই বন্যার প্রত্যক্ষদর্শী। ’৮৮ সালে পানি এত বেশি হয়নি, এত ক্ষয়ক্ষতি ও হাহাকারও উঠেনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার বন্যাসংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ১৮ জুলাই পর্যন্ত কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গতদের জন্য ৫০০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং সাড়ে ১৩ লাখ টাকা জিআর ক্যাশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close