নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৭ জুলাই, ২০১৯

লাখো মানুষের শ্রদ্ধায় রংপুরে চির শয়ানে এরশাদ

লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় রংপুরের পল্লী নিবাসে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর আগে কবরের পাশে তার লাশকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় উপস্থিত জনতা ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। রংপুরের মানুষের ভালোবাসায় শ্রদ্ধা রেখে পল্লী নিবাসেই এরশাদকে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় পার্টি। এর আগে নানা নাটকীয় ঘটনার উদ্ভব ঘটে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পার্টির সিনিয়র নেতারা এরশাদকে সমাহিত করার বিষয়ে চূড়ান্ত এ সিদ্ধান্ত নেন।

তবে এরশাদকে রাজধানী বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফন করার বিষয়ে গত সোমবার পর্যন্ত চূড়ান্ত করে রেখেছিল দল ও কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু রংপুরে নিজ জেলায় এরশাদের লাশসহ কফিন পৌঁছানোর পর সব ধরনের পরিকল্পনাতে পরিবর্তন আসে। স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সেখানকার সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় নেতার লাশ পল্লী নিবাসে দাফনে একাট্টা প্রকাশ করেন। এ নিয়ে তোপের মুখে পড়েন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও এরশাদের ভাই জি এম কাদের।

কারণ পল্লীবন্ধুকে নিয়ে রংপুরের মানুষের এক ধরনের আবেগ কাজ করে। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় স্থানীয়দের মধ্যে। সেই আবেগ থেকেই কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এখানকার নেতাকর্মীরা পল্লী নিবাসে এরশাদের জন্য কবর খুঁড়ে রাখেন। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকলে পল্লী নিবাসে এরশাদের সমাহিত করার অনুমতি দেন তার স্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ। একই সঙ্গে এরশাদের কবরের পাশে নিজের জন্য কবরের জায়গা রাখার অসিহত করেন রওশন এরশাদ। পরে এরশাদের ছোট ভাই ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাও পল্লী নিবাসে এরশাদকে সমাহিত করা হবে এ ঘোষণা দেয়ার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দ উল্লাস বয়ে যায়। অনেকের চোখে আবেগে পানি চলে আসতে দেখা যায়।

উল্লেখ্য, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু এরশাদ রংপুর-৩ (সদর) আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি এ আসন থেকে টানা ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রংপুরকে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বিবেচনা করা হয়। এরশাদ জেলে থেকেও এখান থেকে ভোট করে বারবার নির্বাচিত হয়েছেন।

জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টা ২৯ মিনিটে রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় এরশাদের জানাজা। রংপুর কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাশ পল্লী নিবাসে নেয়া হয়। এরশাদের কফিনবাহী গাড়িতে ওই সময়ে ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা।

এরশাদের জানাজায় ইমামতি করেন রংপুর করিমিয়া নুরুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মুহম্মদ ইদ্রিস আলী। জানাজা শুরু হয় দুপুর ২টা ২৭ মিনিটে। শেষ হয় ২টা ২৯ মিনিটে। জানাজা শেষে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এরশাদের লাশে শ্রদ্ধা জানান। প্রিয় নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঢল নামে। এ সময় উত্তরাঞ্চলে ১৬ জেলার লক্ষাধিক বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ প্রিয় নেতার কবরে মাটি দিতে অংশ নেয়। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর কড়া নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুশৃঙ্খল সহযোগিতায় দাফন কার্য সম্পন্ন হয়।

জানাজার আগে এরশাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া চেয়ে বক্তৃতা করেন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের, এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদও।

রংপুরের মেয়র পল্লীবন্ধুকে রংপুরে পল্লী নিবাসে খোঁড়া কবরে সমাহিত করার ঘোষণা দেন। তখন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান। এরপরই লাশবাহী গাড়ি পল্লী নিবাসের উদ্দেশে রওনা হয়।

প্রসঙ্গত, গত রোববার সকাল পৌনে ৮টায় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন মৃত্যুবরণ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি রক্তে সংক্রমণসহ লিভার জটিলতায় ভুগছিলেন। ওই দিন (রোববার) বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা এবং বাদ আসর বায়তুল মোকাররম মসজিদে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রংপুরে চতুর্থ জানাজা শেষ হয়েছে পল্লী নিবাসে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে দিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি এবং স্বৈরশাসকের তকমা লাগানো এরশাদের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটল।

এদিকে, আমাদের রংপুর ব্যুরো জানায়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রংপুরে জানাজা শেষে প্রায় ৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে তার বাসভবন পল্লী নিবাসেই দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে জানাজা উপস্থিত লাখো জনতার উদ্দেশে জাতীয় পার্টির মহাসচিব আলহাজ মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাই জি এম কাদের আপনাদের উদ্দেশে যে কথাগুলো বলবেন, তা আপনারা শুনবেন ও মেনে নেবেন। এরপর জি এম কাদের এরশাদের শাসনামলের কিছু উন্নয়ন চিত্র উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে এরশাদের লাশ ঢাকায় দাফন করা নিয়ে উত্তেজিত রসিক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান জি এম কাদেরের মাইক্রোফোন কেড়ে নেন। কারণ এরশাদ সিএমএইচে চিকিৎসাধীন থাকার সময় থেকেই রংপুর জাতীয় পার্টির নেতারা তাকে রংপুরে দাফনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের যুক্তি এরশাদ বলে গেছেন মৃত্যু হলে তাকে যেন রংপুরে পল্লী নিবাসে দাফন করা হয়। সোমবার সন্ধ্যায় রংপুর নগরীর দর্শনা এলাকায় এরশাদের বাসভবন পল্লী নিবাসের পাশে তার বাবা মরহুম মকবুল হোসেন মেমোরিয়াল হাসপাতাল এলাকায় লিচু বাগান চত্বরে তার জন্য কবরও খনন করা হয়। রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর জাতীয় পার্টি সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে কবরের জায়গা নির্ধারণ এবং নিজেই মাটি কেটে কবর খননের কাজ শুরু করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close