প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ১৭ জুলাই, ২০১৯

বন্যার অবনতি

বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে বাড়িঘরে পানি

সারা দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যেই ১৫টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ জায়গায় নদ-নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সড়ক বা বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও হাতিবান্ধা ও গাইবান্ধা শহরে পানি ঢুকে পড়েছে। বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা। নদীভাঙন ও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। হাতিবান্ধায় সতি নদী ও পাটগ্রামে ধরলা নদী থেকে গতকাল দুটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কুড়িগ্রামের উলিপুরে চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

লালমনিরহাট : গত দুই দিনে জেলায় পাহাড়ি ঢালের পানি একটু কমলেও হঠাৎ করে তিস্তার পানি গত সোমবার থেকে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। পুনরায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা এডিসি (রাজস্ব) আহসান হাবীব। তিনি জানিয়েছেন, বন্যায় সদর উপজেলাসহ পাঁচ উপজেলার ২০ ইউনিয়নের ১৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ২৪৫ মেট্রিক টন জিআর চাল ও ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়। ১ হাজার ৪০০ পরিবারের মাঝে শুকনা খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়। এখনো মজুদ আছে ২০৫ মেট্রিক টন চাল ও ৩ লাখ টাকা। যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। লালমনিরহাটে বন্যায় ১৯০ হেক্টর জমির রোপা আমনসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গত সোমবার বাঁধ ও সড়কের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে হাতিবান্ধা শহরে তিস্তার পানি প্রবেশ করছে। গত দুই দিনের মধ্যে হাতিবান্ধায় সতি নদী ও পাটগ্রাম উপজেলার ধরলা নদী থেকে ভেসে আসা দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিস্তা ব্যারাজ দোয়ানী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, মূলত ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেট খুলে দেওয়ায় এবং গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

উলিপুর (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রামের উলিপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত সোমবার দুপুরে উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্যাপারীপাড়া গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে হাবিবুল্লাহ্ নামে ছয় বছরের এক শিশু মারা গেছে। এছাড়া রুনা বেগম (২৮) রূপা মনি (৮) ও হাসিবুল ইসলাম (৭) বন্যা দেখতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যান। এছাড়াও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কাশিমবাজার লখিয়ারপাড়ার তিস্তার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নের চরটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় জলমগ্ন হওয়ায় প্রশাসন বন্ধ ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে সাতটি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আমন বীজতলা ২৬০ হেক্টর, আউস ২৮০ হেক্টর, সবজি ১৪০ হেক্টর, পাট ৪৮০ হেক্টরসহ কিছু সংখ্যক কলা, ভুট্টাখেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

রাউজান : রাউজানের সর্তা ও ডাবুয়া খালের বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বহু রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর পানি নামতে শুরু করলেও ক্ষত-বিধ্বস্থ সড়কের কঙ্কাল বের হয়ে পড়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিকদাইর, রাউজান সদর ইউনিয়ন, নোয়াজিশপুর, ডাবুয়া, হলদিয়া, উরকিরচর, বিনাজুরী, পশ্চিম গুজরা, নোয়াপাড়ার রাস্তাঘাট। সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে রঘুনন্দন বাড়ি সড়ক, সাহেববিবি সড়ক, মোহাম্মদ তকির সড়ক, আকবর শাহ সড়ক, মহেন্দ্র বাড়ি সড়ক, নীলকমল কবিরাজ সড়ক, পাঠানপাড়া সড়ক। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় করাঙ্গী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ভারি বর্ষণে বাহুবল বাজারসংলগ্ন করাঙ্গী নদীর ওপরের সেতুর এক পাশের মাটিতে ধস দেখা দিয়েছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ব্রিজটি। প্লাবিত হওয়া ভাদেশ্বর ইউনিয়নের গ্রামগুলোর মধ্যে বড়গাঁও, শফিয়াবাদ, সাহানগর, গাংপাড়, রশিদপুর, পূর্ব ভাদেশ্বর, কসবাকরিমপুর, ডুমগাঁও, নোয়াগাঁও, পুরান মৌড়ি, জয়নাবাদ, বাহুবল, উত্তরসুর, কবিরপুর, মানিকা অন্যতম।

শেরপুর : শেরপুরের পাঁচটি উপজেলার বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হয়ে প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকার প্রায় অর্ধশত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে বন্যার্তদের জন্য ৩৫ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে এবং সরকারের কাছে আরো ২৫০ টন চাল চাওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, ঝিনাইগাতি উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঝিনাইগাতি সদর ইউপি চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন বলেন, মহারশি নদীর বাঁধের পূর্ব দিঘিরপাড় এলাকায় ১৫০ মিটার অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যে কোনো সময় এটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

ধানশাইল ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, সোমেশ্বরী নদীর পানির প্রবল তোড়ে ধানশাইল ইউনিয়নের নয়াপাড়া, দাড়িয়ারপাড়, কান্দুলী, মাঝাপাড়া ও বাগেরভিটা গ্রামের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঢলের পানির প্রবল তোড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ধানশাইল-বাগেরভিটা-ভটপুর সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি সেতু।

ঝিনাইগাতি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ঢলের পানিতে ১৫০ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলা, ৫০ হেক্টর জমির সবজিখেত ও পাঁচ হেক্টর জমির পেঁপে বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নালিতাবাড়ী উপজেলার মরিচপুরান এলাকায় দুটি স্থানে ভোগাই নদীর সাড়ে ৬০০ ফুট বাঁধ ভেঙে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর পানির তীব্র স্রোতে ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে বাছুর আলগা দক্ষিণপাড়া, চকবড়ইগাছী গ্রামের আফাজ উদ্দিন ও আছিয়া বেগমের বাড়িঘরসহ বেশি কিছু আবাদি জমি ও চলাচলের রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের বকশীগঞ্জে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ এবং দশানী নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের গাজীরপাড়া-আলীরপাড়া গ্রামের বাঁধ সোমবার রাতে ভেঙে গেছে। বাঁধ ভেঙে আচ্চাকান্দি, গাজীরপাড়া, দাসপাড়া, মাঝের পাড়া, নীলেরচর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই ইউনিয়নের বিলেরপাড় থেকে কামালেরবার্তী রাস্তাটি পানির তোড়ে ভেঙে গেছে।

জেলা প্রশাসন থেকে বকশীগঞ্জের বন্যার্তদের জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল গত চার দিন আগে বরাদ্দ করা হলেও এখন পর্যন্ত সেই চাল বিতরণ করা হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মেরুরচর ইউনিয়নের ভাটি কলকিহারা গ্রামে ইউএনওর নেতৃত্বে ৬০টি পরিবারকে শুকনো খাবার বিতরণ করেছে উপজেলা প্রশাসন।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধা অংশে ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। শহরসংলগ্ন খোলাহাটী ইউনিয়নের গোদারহাট এলাকায় সোনাইল বাঁধের প্রায় ১০০ ফুট এলাকা ধসে যাওয়ায় শহরের কুটিপাড়া, পূর্বপাড়া, সবুজপাড়া, ডেভিড কোম্পানিপাড়া, মুন্সীপাড়া, বানিয়ারজানসহ বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উঠেছে গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ উপমহাসড়ক, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, টেনিস কমপ্লেক্স, পুরাতন বাজারসহ আশপাশের এলাকায়।

মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় জেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১৩৫ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৯১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে তিস্তার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।

মঙ্গলবার জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের ২২৪টি গ্রামের ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৬৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০টি। বন্যাকবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য ১১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৪২ হাজার ১০২ জন। বন্যায় কাঁচা রাস্তা ৯২ কিলোমিটার, ছয়টি কালভার্ট এবং চার কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে ১ হাজার ২৪৬ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে চার কিলোমিটার। ৩৩২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ওই চার উপজেলায় জেলা ত্রাণভান্ডার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার মেট্রিক চাল ও ১০ লাখ টাকা এবং ১০ হাজার কার্টন শুকনা খাবার।

গোলাপগঞ্জ : সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা দিয়ে বয়ে চলা কুশিয়ারা ও সুরমার পানি স্থিতিশীল রয়েছে। গত কয়েক দিনে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে শরীফগঞ্জ, বুধবারীবাজার, বাদেপাশা, ভাদেশ্বরসহ বাঘা ইউনিয়নে বন্যার পানিতে ঢুকে পড়েছে, প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, অসংখ্য রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি বাজার। গতকাল মঙ্গলবার কুশিয়ারার তীরে গড়ে উঠা উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের মীরগঞ্জ বাজার বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

তবে সেখানে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তরা সহায়তা পায়নি বলেন জানান স্থানীয়রা। বন্যাকবলিত বুধবারীবাজার ইউপির আওই, কটলিপাড়া, বাণীগ্রাম, বহরগ্রাম, ছত্রিশ কালিজুরী, বাগিরঘাট, চন্দরপুর, আমকোনা, মুল্লারকোনা, বাগলা, রাকুয়ার বাজার, ডেপুটি বাজার, শান্তির বাজার ও কুশিয়ারার ওপারে শরীফগঞ্জ ইউপির খাটকাই, কদুপুর, সুড়িকান্দি, নুরজাহানপুর, কালিকৃষ্ণপুর ও রাংজিয়লসহ ১০ থেকে ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের সহযোগিতায় যতটুকু প্রয়োজন প্রদান করা হবে। মীরগঞ্জ এলাকায় বন্যা দুর্গতদের সহায়তার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত উপজেলায় ২২ টন খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close