জুবায়ের চৌধুরী

  ১৯ মে, ২০১৯

মাদকবিরোধী অভিযানের ১ বছর

গ্রেফতার দেড় লক্ষাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩২৯

গেল এক বছর ধরে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে যুদ্ধ ঘোষণা করে কারবারিদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই অংশ হিসেবে মাদকবিরোধী অভিযানে দেড় লক্ষাধিক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ অন্যান্য সংস্থা। একই সময়ে র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২৯ মাদক কারবারি। তবে এসব ঘটনায় এখনো মাদক চোরাচালানের কোনো গডফাদার আটক বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা নেই। এদিকে টানা অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ইয়াবার প্রধান রুট কক্সবাজারের টেকনাফের ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণও করেছে। তবে বেশিরভাগ মাদক কারবারি আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ইয়াবার কারবার ঠেকানো যাচ্ছে না।

জোরালো অভিযানের পরও বাংলাদেশে মাদকের ব্যবহার কেন কমছে না? এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় সবারই জানা। দেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়। বড় মাদক কারবারি আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি। অথচ সরকারের তালিকায় শীর্ষ মাদক কারবারি মাত্র ১৪১ জন। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিই আছেন। আবার দেশে যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য ধরা পড়ে তা বিক্রি হওয়া মাদকের মাত্র ১০ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশ মাদকই ধরা পড়ে না। অন্যদিকে মাদক বহনকারী বা খুচরা বিক্রেতা আছে কয়েক হাজার। কোনো কোনো মাদকসেবী আবার খুচরা মাদক বিক্রেতা হিসেবেও কাজ করেন। শুধু শহরাঞ্চল নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মাদকের অবাধ সরবরাহ। আর ঢাকাসহ শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাদকসেবী এবং কারবারিদের বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মরণনেশা ইয়াবাকে ঘিরে দেশে তৈরি হয়েছে একটি বিরাট অবৈধ মার্কেট। মাদকদ্রব্য কেনায় বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মাদকাসক্তরা।

মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা ট্যাবলেটই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, প্রতিটির দাম ২০০ টাকা হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবার ব্যবহার ৮০ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। ৭০ লাখের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী আছে ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।

এদিকে গত বছরের ৩ মে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পর অভিযান জোরদার করা হয় ১৫ মে থেকে। এই এক বছরে র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে দেড় লক্ষাধিক মাদক কারবারি। যার মধ্যে গত বছরের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ১ মে পর্যন্ত র‌্যাব গ্রেফতার করেছে ২৪ হাজার ৮৯৮ জনকে। পুলিশ গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৮৮টি মাদক মামলায় যে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৯৫ জন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে, তার বেশিরভাগই মাদক অভিযানের সময়ে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর গত বছরের মে মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪ হাজার ৩০৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া বিজিবি, কোস্টগার্ড কয়েক হাজার ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করেছে। গত বছরের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ১ মে পর্যন্ত শুধু র‌্যাবই উদ্ধার করেছে ৬০৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য।

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ১৫ মে থেকে চলতি বছরের ৯ মে পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৩২৯ মাদক কারবারি। এর মধ্যে ১০৯ জন র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসে আছে। চাইলেই অল্প সময়ের মধ্যে থামানো যাবে না। তবে চলমান অভিযানে মাদকের বিস্তার রোধের উন্নতি হয়েছে।

র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য অধিদফতরসহ অন্যদের অভিযানে এত মাদক কারবারি নিহত এবং অসংখ্য মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সত্ত্বেও মাদকের চালান বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। অনেক কারবারি শুধু পুরোনো কাস্টমারের কাছে ইয়াবা বিক্রি করছে। ফলে তাদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের দেশে মাদক তৈরি না হলেও দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহ থাকায় একটা ডিমান্ড তৈরি হয়েছে। ফলে মাদক সহজে থামবে না। মাদকের আগ্রাসন থামাতে সরবরাহ বন্ধের দিকে নজর দিতে হবে।

র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিনিয়ত ইয়াবার রুট পরিবর্তন ও ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না ইয়াবার চালান। এছাড়াও অনলাইনে ইয়াবা বিক্রির বিষয়টি অনেকটাই তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, মাদক কখনোই নির্মূল করা সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাদক একেবারেই থাকবে না, এই নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা মাদকের সরবরাহ বন্ধ করতে সব জায়গায় কাজ করছি। মাদকের মূল গডফাদার থেকে শুরু করে এর বিক্রেতা, পাচারকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি আরো জানান, মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। দেশের প্রত্যেকটি পরিবারকে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close