নিজস্ব প্রতিবেদক ও পাবনা প্রতিনিধি

  ০৯ এপ্রিল, ২০১৯

পাবনায় যে কারণে ৬১৪ চরমপন্থির আত্মসমর্পণ

আজ মঙ্গলবার পাবনায় আত্মসমর্পণ করছে এলাকায় চরমপন্থি দল বলে পরিচিত তিনটি কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রুপের ছয় শতাধিক নেতাকর্মী। পুলিশ ও আওয়ামীর লীগের স্থানীয় এক সংসদ সদদ্যের মতে তারা গণবিচ্ছিন্ন সামাজিক অপরাধী। তাদের সমাজ বদলের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তাছাড়া গোপনে পালিয়ে থেকে রাজনৈতিক সংগঠন করার মতো বাস্তবতা আর নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন পৌঁছে যাওয়ার কারণে গ্রাম বা যমুনার চরে লুকিয়ে থাকা আর তাদের পক্ষে সম্ভব না। মানুষ তাদের আর সমর্থন করে না। নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা তাদের দলের সদস্য হয় না। তাই এ তিন দলের পুরোনো নেতারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকারের কাছে অস্ত্র জামা দিয়ে আত্মসমর্পণ করছে। তবে দেশে গোপন কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সম্পর্কে জানাশোনা এবং এই গোপন ধারার এক সাবেক নেতা জানিয়েছেন পাবনায় যারা আত্মসমর্পণ করছে তারা আগে থেকেই এসব দল থেকে থেকে বহিষ্কৃত ও আদর্শচ্যুত। এখন সুযোগ বুঝে সরকারের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। এরা সুবিধাবাদী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই ৬১৪ জন চরমপন্থি নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব-বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব-বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এবং নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। একসময়ে পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল এসব দলের সশস্ত্র ব্যক্তিরা, দিনে-দুপুরে মানুষ হত্যা করে রাস্তার ওপর ফেলে রেখে দিত, নারী ধর্ষণ, চাঁদাবাজি এবং গ্রামের ধনি পরিবারে লুঠতরাজই ছিল তাদের জীবিকার মাধ্যম। এই অভিযোগ করেছেন এই দল তিনটির কর্ম এলাকার একাধিক ব্যক্তি। তবে তারা নাম প্রকাশে রাজি হননি। ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও এই সংগঠনের কর্মকা- প্রায় একই ধরনের। চরমপন্থি বলে চিহ্নিত এমন ৬১৪ জন আত্মসমর্পণ করছেন। পাবনা জেলাসহ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ১৫টি জেলার চরমপন্থি নেতারা খুন-খারাবির পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে তারা শান্তিতে জীবনযাপন করতে রাজি হয়েছেন। এ উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় তাদের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ হবে পাবনার শহীদ আমিন উদ্দিন স্টেডিয়াম মাঠে।

জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান এসব চরমপন্থি। দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করবেন প্রায় ১৬টি জেলা থেকে চরমপন্থি দলের সদস্যরা।

নিজ নিজ জেলা পুলিশ কর্মকর্তারা গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের নিয়ে যাবেন পাবনায়। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আত্মসমর্পণের পর এসব ব্যক্তির মামলা-মোকদ্দমা দেখে সেই অনুযায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। যারা অস্ত্র জমা দেবেন, তাদের তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনা হবে। যাদের নামে মামলা রয়েছে, সেগুলোর বিচার দ্রুত শুরু করা হবে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন, সেজন্য সব ধরনের সুবিধা দেবে সরকার।

পাবনা প্রেস ক্লাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে পূর্ব-বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি। তারা ধনীর সম্পদ গরিবের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলে এসব এলাকায় হত্যা, ডাকাতি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে। তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার আগেই এসব জেলায় সক্রিয় ছিল। তাদের আদর্শ ছিল চীনের নেতা মাওসেতুং এবং ক্ষমতা দখলের কৌশল ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও। তারা গ্রামের ধনি শ্রেণি কৃষককে শত্রু মনে করত। তাদের গলা কেটে হত্যাও করেছে। তাদের সেøাগান ছিল নকশালবাড়ীর (ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ী) লাল আগুন সারা বাংলায় ছড়িয়ে দাও। এক পর্যায়ে তারা দলীয় কোন্দলে জড়িয়েছে নিজেরা নিজেরা খুনাখুনি করেছে, র‌্যাপ-পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়েছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে চোর-ডাকাতে পরিণত হয়েছে। এরা গ্রামীণ মানুষের গোষ্ঠী কোন্দল শিকার হয়ে খুন হয়েছে। এখন তো আর সমাজতান্ত্রিক চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সর্বশেষ কিউবায়ও শুরু হয়েছে বাজার অর্থনীতি, ভারতের নকশালরা বিজেপিতে ভিড়েছে, বাকিরা সরকারি বাহিনীর অভিযানে প্রায় নিঃশেষ। কোন ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সামনে রেখে তারা সমাজ বদলের লড়াই করবে? তাদের জন্য সমর্থন নেই। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে তাদের লুকিয়ে থাকার স্থানগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নখদপর্ণে। আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের সামনে আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

গত শতাব্দীর ৮০-এর দশক থেকে পূর্ব-বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে এসব এলাকার দুর্গম চরাঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করে। বর্তমানে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে চরমপন্থিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহজেই ধরা পড়ে যাচ্ছে। এ কারণেই সক্রিয় চরমপন্থি দলগুলো এখন অনেকটাই কোণঠাসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি মেম্বার জানান, এসব দলের সমর্থন সমাজে আর নেই। সমাজ বিপ্লবের নামধারী এসব দল এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে।

পাবনা জেলা পুলিশের একটি তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চরমপন্থি দলগুলো অন্তঃকোন্দল ও পুলিশি অভিযানে মারা গেছে ১৯৭ জন। আজ মঙ্গলবার পাবনায় বাবলু প্রামাণিকের নেতৃত্বে পূর্ব-বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা) এবং ইউসুফ ফকিরের নেতৃত্বে পূর্ব-বাংলার সর্বহারা দলের ১৬০ জন চরমপন্থি সদস্যের অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করছে।

চরমপন্থি সংগঠনগুলোর আত্মসমর্পণের দিনের নিরাপত্তা জোরদারে পাবনার শহীদ আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ওই দিন পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য শহরে মোতায়েন করা হবে। এছাড়া থাকবেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাবনা জেলা পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, তারা সবাই গোপন সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য। সে কারণে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হবে।

একসময় সমাজ বদলের অঙ্গীকার নিয়ে যারা শোষক ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল তাদের ৬১৪ জন ক্যাডার এখন কী পরিস্তিতিতে আত্মসমর্পণ করছে এই প্রশ্ন করা হয় সিরাজ শিকদারের সঙ্গে রাজনীতি করতেন এমন একজন রাজনীতিক ও সমাজ গবেষককে। তিনি একসময় সর্বহারা পার্টির ফরিদপুর অঞ্চলের পরিচালকও ছিলেন। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, পাবনায় যারা আত্মসমর্পণ করছেন তারা অনেক অগেই পূর্ব-বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা) এবং পূর্ব-বাংলার সর্বহারা পার্টি থেকে বহিষ্কৃত। এদের অনেক আগেই আদর্শচ্যুত হয়েছে। তারা এক ধরনের গণবিচ্ছিন্ন সামাজিক অপরাধী। এতদিন সরকারের আশ্রয়ে ছিল। এখন তাদের সুবিধাবাদী মুখোশটা বেড়িয়ে আসল মাত্র।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close