নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২০ মার্চ, ২০১৯

ফের সড়কে ছাত্রের প্রাণ রাজপথ উত্তাল, অবরোধ

* শিক্ষার্থীদের ৮ দফা দাবি * আবরারের দাফন * বাস জব্দ, চালক আটক

বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় আবার উত্তাল ঢাকার রাজপথ। দিনব্যাপী সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা। গত বছরের জুলাইয়ে দুই স্কুলশিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সপ্তাহব্যাপী টানা আন্দোলনের জেরে সরকারও নিরাপদ সড়কের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এদিকে, পঞ্চমবারের মতো ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের ঘোষিত বিশেষ সেবা সপ্তাহের মধ্যেই গতকাল ওই শিক্ষার্থী নিহত হন।

রাজধানীর বাড্ডার প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের (বিইউপির) এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টায় বসুন্ধরা আবাসিক গেটের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় আবরার আহমেদ চৌধুরী (২০) নামের ওই ছাত্রকে চাপা দেয় বাসটি। নিহত আবরার বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (আইআর) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফ আহমেদ চৌধুরী। আবরার পরিবারের বড় ছেলে। তার ছোট ভাই আবিদ অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে আবরার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহনের একটি বাসে উঠতে গেলে গাজীপুরগামী সুপ্রভাত পরিবহনের বাসটি তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। বাসের চালককে আটক এবং বাসটিও জব্দ করে পুলিশ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আবরারের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছিল। গতকাল বিকেল ৪টায় আবরারের মরদেহ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘাতক সুপ্রভাত বাসকে (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫) জব্দ এবং চালক সিরাজুল ইসলামকে (২৯) আটক করা হয়েছে। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কি না যাচাই-বাছাই চলছে। এ ঘটনায় হেলপার পলাতক।

এদিকে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ১৭ মার্চ থেকে রাজধানীতে পঞ্চমবারের মতো শুরু হয়েছে ট্রাফিক সপ্তাহ। এরই মধ্যে বাসচাপায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলো। গত বছরের ২৯ জুলাই রমিজ উদ্দিন স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের জেরে ও সরকারের সদিচ্ছায় কিছু কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু হয়, যা এখনো চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। আবরারও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন আর তিনিই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন। গতকাল তার মৃত্যুতে ইউনিভার্সিটির সহপাঠীদের আন্দোলনে ফের উত্তাল ঢাকার রাজপথ।

গতকাল সকালে আবরারের মৃত্যুর খবর পেয়ে বসুন্ধরা আবাসিক গেট এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে অবরোধ করে বিইউপির শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শিক্ষার্থীদের অবরোধে বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা হয়ে রামপুরা-গুলিস্তান রুটের যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুরের পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ইনডিপেনডেন্ট ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। বিইউপির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তারা রাস্তা অবরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিভিন্ন ধরনের সেøাগান দিতে থাকেন। ‘নিয়মের চক্রে মরে শেষ হচ্ছি’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; আবিরের বুকে রক্ত কেন?, কয়লার সড়কে রক্ত কেন?; ‘নিরাপদ সড়ক চাই; ভাইয়ের বুকে রক্ত কেন?; ‘প্রশাসনের প্রহসন মানি না মানব না’; ‘জেগেছে রে জেগেছে ছাত্রসমাজ জেগেছে’; ‘সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হোক’; ‘আমার ভাইয়ের বুকের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’; ‘আবরার তোর স্মরণে, ভয় পাই না মরণে’ ইত্যাদি সেøাগানে প্রকম্পিত থাকে নর্দা ও বসুন্ধরা গেট এলাকা।

এদিকে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে পুলিশ, ওই এলাকার কাউন্সিলর ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রায় ১০ ঘণ্টা পর প্রগতি সরণিতে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। আজ বুধবার সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেবেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিকেলে ডাকসুর নতুন ভিপি নুরুল হক নুর শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

এর আগে খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা সিটি উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম ছুটে আসেন। মেয়রের কাছে মৌখিকভাবে ১২ দফা দাবি উত্থাপন করেন আন্দোলনকারীরা। তাৎক্ষণিকভাবে মেয়র তাদের দাবি মেনে সঙ্গে সঙ্গেই আবরারের নামে দুর্ঘটনাস্থলে তিন মাসের মধ্যে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ ও সুপ্রভাত পরিবহনের লাইসেন্স বাতিলের ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে তাদের সব দাবি লিখিতভাবে দেওয়ারও আহ্বান জানান। তারপর শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ তুলে নিতে বললেও তারা মানেননি। একপর্যায়ে তারা ৮ দফা লিখিত দাবি তুলে ধরেন।

শিক্ষার্থীদের লিখিত দাবিগুলো হচ্ছে, পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রতি মাসে বাসচালকের লাইসেন্সসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। আটক চালক ও সম্পৃক্ত সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আজ থেকে ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ে অপসারণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডারপাস, স্পিড ব্রেকার এবং ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়ক হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রীছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিক্ষার্থীদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালুর দাবি জানানো হয়।

শিক্ষার্থীদের ফাঁসাতে বাসে আগুন শ্রমিকের : আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ফাঁসাতে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সুপ্রভাত বাসের এক হেলপার বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা ওই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। ওই শ্রমিককে ধরতে গেলে পুলিশ কৌশলে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে বলে অভিযোগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে বিইউপি ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। পরে প্রকৃত বিষয়টি ধরা পড়লে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা পানি এনে বাসের আগুন নেভানোরও চেষ্টা করেন।

সড়ক অবরোধে দুর্ভোগ, তবু নিরাপদ সড়ক চায় সবাই : গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নতুন বাজার থেকে রামপুরা সড়কে এবং কুড়িল বিশ্বরোড থেকে খিলক্ষেতের রাস্তায় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। বসুন্ধরা এলাকায় পুরো যান চলাচল বন্ধ ছিল। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তবু পথচারীরা বলছেন, কষ্ট হলেও আমরা চাই সড়ক নিরাপদ হোক।

সাইদুর রহমান নামের একজন পথচারী বলেন, ‘আমি কুড়িল বিশ্বরোড থেকে হেঁটে এসেছি। ভোগান্তি হচ্ছে। তবু আমরা চাই সড়ক নিরাপদ হোক। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।’

বনানী কবরস্থানে আবরারের দাফন : সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে বনানী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এর আগে দুপুর দেড়টায় মিরপুর সেনানিবাসে বিইউপি এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় তার বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী, বিইউপির ভিসি মেজর জেনারেল মো. এমদাদ-উল বারী, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম, আবরার আহমেদের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আত্মীয়স্বজন অংশ নেন।

এ সময় আবরারের বাবা ব্রি. জে. (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী মুষড়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্টের সময় পার করেছি। ছেলেকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার মতো কষ্ট আর কিছুর সঙ্গে মিলবে না। জীবনের সব সফলতা একটি ঘটনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন মা ফরিদা ফাতেমী। কান্নার ফাঁকেই বলতে থাকেন, ‘পরিবারের মাথার মুকুট ছিলি তুই। আমাদের একা ফেলে চলে গেলি কীভাবে, বাবা? আমি কীভাবে তোকে ছাড়া থাকব? তুই একবার ফিরে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাক, বাবা।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close