গাজী শাহনেওয়াজ

  ১৩ মার্চ, ২০১৯

শিক্ষা মন্ত্রণালয়

আইসিটি সামগ্রী পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ক্রয়চেষ্টার অভিযোগ

অভিযোগ সংসদীয় কমিটি পর্যন্ত গড়িয়েছে

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীন তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) সামগ্রী ক্রয়ে নিয়ম মানতে রাজি নন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিধি উপেক্ষা করে আইসিটি প্রকল্পের শিক্ষা উপকরণগুলো সরাসরি কেনার উদ্যোগ নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই অভিযোগে জানা যায়, প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিদের পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠানকে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজটি দিয়ে কেনাকাটায় বাণিজ্য করা। সরকারি কেনাকাটায় প্রচলিত অনিয়ম বন্ধে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির (ডিটিএম) বদলে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি (ওটিএম) অনুসরণে সরকারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। পাশাপাশি, বিতর্ক এড়াতে প্রকল্পের পরামর্শক সংস্থাগুলোও রয়েছে ওটিএম অনুসরণের পক্ষে।

সরকার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজে স্বচ্ছতায় একাট্টা থাকলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কেন উল্টো পথে হাঁটছেনÑ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রকল্পে ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পে প্রথম ধাপে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সদ্য গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে। কমিটির সভাপতি বলছেন, এ নিয়ে সভা করে অনিয়ম বন্ধে সুপারিশ করবে কমিটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশের ৩ হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের জন্য ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, সাউন্ডবক্স, মডেম ইত্যাদি সরবরাহ করা হবে। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। যেখানে শিক্ষা উপকরণ কেনায় ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ অর্থাৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকারী শিক্ষা উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল সার্ভিসেস এভি (বিডি) লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মো. মুজিবুল হক জানান, দেশে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, সাউন্ডবক্স, মডেম উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে ডিটিএম পদ্ধতিতে ওই শিক্ষা উপকরণ কেনা হলে চীন থেকে নন-ব্র্যান্ড পণ্য এনে স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নমানের পণ্য পাবে এবং বিক্রয়োত্তর সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ওটিএম পদ্ধতিতে কেনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম পর্যায়ে আইসিটি উপকরণ সামগ্রী সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের একজন মহাব্যবস্থাপক জানান, আমরা চাইছি কাজে স্বচ্ছতা; যার জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বিধি অনুসরণ না করতে পাঁয়তারা করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তারা অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজটি করতে যাচ্ছে। কারণ এতে ১০ টাকার জিনিস দ্বিগুণ মূল্য দেখিয়ে কিংবা অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে আইসিটি সামগ্রী কিনে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সরকারকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে। পাশাপাশি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে উপকরণ সামগ্রী পাবে তা হবে নিম্নমানের। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা, যোগ করেন ওই কর্মকর্তারা।

আইসিটি প্রকল্পের পিডি প্রফেসর ড. আবদুস সবুর খান এ বিষয়ে বলেন, সরকার চাইলে যে কোনো পণ্য সরাসরি ক্রয় করতে পারে। শিক্ষা উপকরণ কেনার ক্ষেত্রেও ডিপিপি অনুসরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

সূত্র মতে, সদ্য গঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তাদের অনৈতিক তৎপরতার কারণে ক্রয়-প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। নানা অভিযোগের কারণে দায়িত্ব পালনরত প্রকল্প কর্মকর্তাকে ওএসডি করে মন্ত্রণালয়। এরপরও প্রকল্প ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে সব পণ্য ডিটিএম পদ্ধতি কেনার পাঁয়তারা চলছে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান ও কিছু অসাধু ব্যক্তির স্বার্থে নেওয়া এ উদ্যোগ বাতিল করে ওটিএম পদ্ধতিতে কেনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

সংসদীয় কমিটির সদস্য এম এ মতিন বলেন, সরকারি কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে সংসদীয় কমিটি। এক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগ নিয়ে কমিটির বৈঠকে আলোচনা হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রকল্পের কার্যক্রম রেগুলেটর, সুপারভাইজ ও মনিটর করার জন্য প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তিনজন পরামর্শক নিয়োগের প্রকল্প দলিলে (ডিপিপি) তা নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পরে নানামুখী চাপের কারণে নিয়োগ দেওয়া হলে তারা শিক্ষা উপকরণ কেনায় ওটিএম পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ওই পরামর্শ উপেক্ষা করায় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিখিতভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছে।

এদিকে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে কাজ নিয়ে অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালকসহ দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অধীন কর্মকর্তাদের মতামত না নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার নথি অনুমোদন করেছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার মাধ্যমে অনিয়ম করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ওই প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত ১৩টি অভিযোগের মধ্যে ১২টির সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close