নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

চকবাজার ট্র্যাজেডি

রাসায়নিকের কারখানা গুদাম অপসারণ শুরু

ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে অঙ্গার পাঁচটি ভবন। সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৭ জন। আহত হয়েছেন অর্ধশত। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ৯ জন। ভয়াবহ এ অগ্নিকা-ের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাড়িভাড়া নিয়ে গুদামে মজুদ রাখা রাসায়নিক। আগুন লাগার কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভবনগুলোর গুদামে রাখা রাসায়নিক থেকে যে আগুন ছড়িয়েছে, সে বিষয়ে সবাই একমত। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, চকবাজার এলাকায় ৭০ ভাগের বেশি ভবনে বিভিন্ন পণ্য ও রাসায়নিকে গুদাম রয়েছে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ গুদামের পেছনে রয়েছে ভবন মালিকদের বেশি মুনাফার লোভ, প্রশাসনের অবহেলা এবং স্থানীয়দের অসচেতনতা।

গতকাল শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে পোড়া রোগীদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে তিনি ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনকে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম সরানোর নির্দেশ দেন। এ সময় মেয়র প্রধানমন্ত্রীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুপুরে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্ট থেকে রাসায়নিক অপসারণের মধ্য দিয়ে ওই এলাকার সব রাসায়নিক গুদাম উচ্ছেদ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। এ সময় তিনি বলেন, এখনো যেসব বাড়ির মালিকরা কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নেননি, সেসব বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অগ্নিকা-ের কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর দুদিন পরই এত বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের মধ্য দিয়ে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গুদাম অপসারণ না হবে, ততক্ষণ এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

সবার সহযোগিতা চেয়ে মেয়র বলেন, পুরান ঢাকায় একেক এলাকায় লাখ লাখ বাড়িঘর রয়েছে। আশা করব স্থানীয়রা আমাদের সহায়তা করবেন। পাশের কোনো বাড়িতে কেমিক্যাল গুদাম দেখতে পেলে আমাদের জানাবেন, পুলিশকে জানাবেন। কারো বাড়িতে কেমিক্যাল গুদাম থাকলে দ্রুত সরিয়ে নিন। নয়তো বাড়ির মালিককেও আইনের আওতায় আনা হবে। সেই সঙ্গে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ যদি কেউ গোডাউনে কেমিক্যাল স্টোর করতে দেখেন বা কেমিক্যাল রাখতে দেখেন, আপনারা আমাদের কন্ট্রোল রুম ‘৯৫৫৬০১৪’ নম্বরে জানান। যে কেউ তার বাড়ির আশপাশে পাড়া-মহল্লায় কেমিক্যাল রাখছে, এমন দৃশ্য দেখেন তাহলে আমাদের কন্ট্রোল রুম, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, কাউন্সিলর অফিসে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জানান, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।

৭০ ভাগের বেশি ভবনে রাসায়নিকের গুদাম : পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে রাসায়নিকের কারখানা রয়েছে। আবার অনুমতি না থাকলেও অনেক আবাসিক ভবনেও রাসায়নিকদ্রব্য কেনাবেচা চলছে দেদার। অনেক আবাসিক ভবনের নিচতলা কিংবা বেজমেন্টে রাসায়নিক মজুদ করছেন ব্যবসায়ীরা। বেশি লাভের আশায় বাড়ির মালিক ভাড়া দিচ্ছেন। এতে নিজের পরিবার ও ভাড়াটিয়ার জীবনঝুঁকির ব্যাপারে নির্লিপ্ত বাড়ির মালিকরা। ৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন তারা। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, চকবাজার এলাকায় ৭০ ভাগের বেশি ভবনে বিভিন্ন পণ্য ও রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ গুদামের পেছনে রয়েছে ভবন মালিকদের বেশি মুনাফার লোভ, প্রশাসনের অবহেলা ও স্থানীয়দের অসচেতনতা।

চকবাজারের দেবিদাস ঘাট লেনের বাসিন্দা নুরু উদ্দিন জানান, আমার ভবনে রাসায়নিকের গুদাম ভাড়া না দিলেও জীবনঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে। কারণ পাশের বাড়ির মালিক রাসায়নিকের গুদামের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। এর পেছনের কারণ হলো লোভ। একই লেনের বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন ফারুক বলেন, ফ্যামিলিকে ভাড়া দিলে মাসে ভাড়া পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ হাজার। অগ্রিম সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু রাসায়নিক গুদামের জন্য ভাড়া দিলে পাওয়া যাচ্ছে ৫০ হাজার, আর অগ্রিম সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা। আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে হবে বলে মনে করেন বাড়ির মালিক আরিফুল ইসলামও। তিনি বলেন, চকবাজারের ৭০ ভাগের বেশি বাড়িতে গুদাম রয়েছে, এতে কোটি কোটি টাকার মুনাফা জড়িত। ঝুঁকি থাকলেও মুনাফার লোভ কেউ ছাড়তে পারছে না। এ কারণে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। প্রশাসন নিয়মিত তদারক করলে এসব গোডাউন রাখার সাধ্য কারো নেই। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনই চায় না এখান থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরানো হোক। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রশাসন টাকা পায়। কেমিক্যালের গোডাউন না থাকলে প্রশাসনের বাড়তি টাকা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

১৯ জনকে শনাক্তে ৩২ জনের ডিএনএ সংগ্রহ : চকবাজারে অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬৭ জন। এর মধ্যে ৪৮ জনের লাশ হস্তান্তর করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এদিকে পুড়ে যাওয়া ১৯ জনের লাশ শনাক্ত হয়নি এখনো। তাদের লাশ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত দুদিনে নিহতদের ৩২ জন স্বজনের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি।

গতকাল শনিবার দুপুরে সিআইডির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুশরাত ইয়াসমিন জানান, শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে অস্থায়ী ক্যাম্পে নমুনা সংগ্রহ করছেন সিআইডির ডিএনএ ল্যাবের কর্মীরা। দুদিনে ৩২ জন স্বজনের ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। যারা এখনো স্বজনদের খুঁজে পাননি, তাদের নমুনা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ল্যাবে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় এক সপ্তাহ, এক মাস বা আরো বেশি সময় লাগতে পারে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close