কাইয়ুম আহমেদ

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ভাষায় পিছিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

বিলুপ্তির পথে ১৪টি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের দুধের মতো।’ ভাষা জাতিসত্তার মূল উপাদান। ভাষাই সম্পর্কের অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন গড়ে তোলে। ভাষার মাধ্যমেই একটা জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, মনোজগৎ এবং তার অগ্রগমন-সবকিছুই প্রতিফলিত হয়। আর ভাষা হারিয়ে গেলে তার সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছুই হারিয়ে যায়। তাইতো এই ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকরা। আর এই মায়ের ভাষার জন্য প্রতিদিন নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে উপকূলের রাখাইন জনগোষ্ঠী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ দেশে আছে প্রায় ৭৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সামাজিক রীতিনীতি ও উৎসব। এদের জীবনমান এখন অনেক উন্নত। কিন্তু চর্চার অভাবে ১৪টি ভাষা বিলুপ্তির পথে। বাকি ২৬টি ভাষাভাষীও নিজ ভাষায় পিছিয়ে রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার অধিকার ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে জাতিসংঘে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে এই উদ্যোগও হালে পানি পাচ্ছে না। এদিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে জীবিত প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে ৪ হাজারেরও বেশি ভাষা বিলুপ্তির পথে। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। তাই এসব ভাষা সংরক্ষণে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩০ লাখ ৮৭ হাজার। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৭ হাজার পার্বত্য চট্টগ্রামে। এরা ৪০টি ভাষা ব্যবহার করে। বর্তমানে ১৪টি ভাষা নানা কারণে বিপন্নের পথে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব আনপিপলিং অব ইন্ডিজিনাস পিপলস : দ্য কেইস অব বাংলাদেশ’ শিরোমে একটি গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ। এখন তা ৪৭ শতাংশ। গত তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে। আর সর্বশেষ আদমশুমারি ও গৃহগণনা বলছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৭টিতেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কমেছে।

ভাষার মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহের আন্তর্জাতিক বর্ষের বৈশ্বিক উদযাপন’ উপলক্ষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে মাসুদ বলেন, আমরা পাহাড়ি জেলাগুলোতে তিনটিসহ মোট সাতটি বিশেষায়িত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছি যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সব উপজাতীয় সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ও ভাষার প্রসার ও সংরক্ষণে কাজ করছে। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ’ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি ও সম্পদ সংরক্ষণে কাজ করছি।

রাজশাহী : বরেন্দ্র সমতল ভূমিতে বসবাস ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর। এর মধ্যে সাঁওতাল ও মহল সম্প্রদায়ের সংখ্যাই বেশি। এদের একটি অংশ শিক্ষিত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষায়। একই সঙ্গে ভুলতে বসেছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। নিজ ঘরেও তেমন চর্চা নেই নিজ ভাষার। শহরে বাসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে মাতৃভাষার ব্যবহার হয় না বললেই চলে। ফলে অনেক শিশুই নিজস্ব ভাষা বুঝতে পারলেও বলতে পারে না। তবে স্কুলে তাদের নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

আমতলী (বরগুনা) থেকে মো. আবু সাইদ খোকন জানান, মায়ের ভাষার জন্য প্রতিদিন লড়াই করে যাচ্ছে উপকূলের পটুয়াখালী ও বরগুনার জেলার রাখাইন জনগোষ্ঠী। তাদের মাতৃভাষা যথাযথ সংরক্ষণ, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, বিকাশ, শিক্ষার অভাবে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, ১৭৮৪ সালে রাখাইনরা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এ দেশের সমুদ্র উপকূলে বসতি স্থাপনা শুরু করে। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায়।

তালতলীর ১২টি পাড়ায় ২ হাজার ৫০০ রাখাইন পরিবারের ছেলেমেদের জন্য বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ভাষা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তাই রাখাইন ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে রাখাইন ভাষা ও কালচারাল ইনস্টিটিউট স্থাপনের দাবি এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর।

এ প্রসঙ্গে বরগুনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, রাখাইন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে বিশেষ প্রকল্প আছে সেখানে যোগাযোগ করা হবে। যাতে রাখাইন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো যায়।

রাঙামাটি থেকে শফিকুল ইসলাম জানান, শ্রণিকক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক সংকটের কারণে রাঙামাটিতে আলোর মুখ দেখছে না মাতৃভাষায় পাঠদান কার্যক্রম। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হলেও শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই।

বনরূপা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অর্চনা তালুুকদার বলেন, চাকমা ভাষা পড়ানোর মতো শিক্ষক থাকলেও মারমা, ত্রিপুরা ভাষার শিক্ষক নেই।

পুলিশ লাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিকু চি মগ বলেন, আমার বিদ্যালয়ে চাকমা ও মারমা কিছু শিক্ষার্থী থাকলেও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য অংসু গ্রু চৌধুরী বলেন, দুই বছর থেকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই মাসেই আবার নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করা হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, আমরা উপজেলাভিত্তিক মাতৃভাষার প্রশিক্ষণের জন্য তালিকা পেয়েছি, যার মধ্যে চাকমা ভাষায় ৭৪৮ জন, মারমা ভাষায় ১০৩ জন, ত্রিপুরা ভাষায় পাঁচজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। জেলায় এ বছর চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার ৮৬ হাজার ৩১৮টি বই বিতরণ করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি থেকে শংকর চৌধুরী জানান, চলতি শিক্ষাবর্ষে খাগড়াছড়িতে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে ৩০ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। তবে প্রাথমিক স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকায় তাদের মাতৃভাষায় পাঠ ব্যাহত হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশা প্রিয় ত্রিপুরা বলেন, সরকার প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই ছাপানো ও সরবরাহ করলেও তা কাজে লাগেনি। কারণ প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াছমিন বলেন, বিভিন্ন স্কুলে মাতৃভাষায় বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে। এছাড়া চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে প্যানেল নির্ধারণ করা হয়েছে।

বান্দরবান থেকে রিমন পালিত জানান, ১১টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে একমাত্র বান্দরবানে। এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হলো ‘মারমা’। তারা ম্রাইমা নামে মিয়ানমার থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছে। পরের স্থান লুসাই জাতিগোষ্ঠীর। এরা প্রায় ১৫০ বছর আগে ভারতের মিজোরাম থেকে এসেছে।

মৌলভীবাজার থেকে ওমর ফারুক জানান, চা শ্রমিকদের মাঝে রয়েছে নৃগোষ্ঠী। কিন্তু দরিদ্রতা, অসচেতনতা এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের কারণে নিজেদের আত্মপরিচয় হারাতে বসেছেন তারা।

জানা গেছে, জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, রাজনগর, বড়লেখাসহ সাত উপজেলায় ৯২টি চা বাগানে প্রায় অর্ধশতাধিক নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তার মধ্যে মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁড়াও, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, বর্মা, কানু, পানিকা, কুর্মী, চাষা, অলমিক, মোদি, তেলি, পাত্র, মাঝি, রাজবংশী, মোদক, বাড়াইক ও ভূমিজ।

এ বিষয়ে জেলা কালচারাল অফিসার জ্যোতি সিনহা বলেন, নৃগোষ্ঠীর চা শ্রমিকদের নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তাদের এক জায়াগায় এনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে যাতে তারা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close