জিয়াউল হক ইমন, চট্টগ্রাম ব্যুরো

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

চট্টগ্রামে বস্তিতে আগুন ৮ জন নিহত

নগরীর বাকলিয়া চাকতাই ভেড়ামার্কেট বস্তিতে অগ্নিকা-ের ঘটনায় একই পরিবারের চারজনসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ৩টার দিকে এ আগুন লাগে। অগ্নিকা-ে পাঁচটিরও বেশি কলোনিতে বিভক্ত ওই বস্তির প্রায় দুই শতাধিক ঘর এবং দোকানপাট পুড়ে গেছে। এই আগুনের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকা-ে নিহতরা হলেন রহিমা আক্তার (৬০), তার মেয়ে নাজমা আক্তার (১৬), ছেলে জাকির হোসেন বাবু (৮), মেয়ে নাসরিন (৪), আয়েশা আক্তার (৩৭), তার ভাগিনা সোহাগ (১৯), হাসিনা আক্তার (৩৫)। বাকি একজনের পরিচয় জানা যায়নি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য যেসব জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে চাক্তাইয়ের বেড়া মার্কেট সংলগ্ন বস্তিও একটি। কর্ণফুলীতে উচ্ছেদ শুরুর পর জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা গিয়ে একাধিকবার বস্তির বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও সরকারি খাসজমির দখলদাররা তা কর্ণপাত না করে বরং বস্তিতে বাসিন্দাদের বসবাস করতে উৎসাহ জোগায়। পাশাপাশি তাদের থাকতে বাধ্য করেন। যারা থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আটজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আগুন। জীবনের শেষ সম্বল, সহায়-সম্পদও বিসর্জন দিতে হয়েছে আগুনে।

একই বস্তির বাসিন্দা সুফিয়া প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, ‘মুখে কাপড় বেঁধে ৪-৫ জন এসে কতগুলো পাউডার ছিটিয়ে পরে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় বাঁচতে। সুফিয়া আরো বলেন, তারা ঘর ছাড়তে কোনো নোটিশ পাননি বরং তাদের জমিদার ‘নাছির’ তাদের ঘর না ছাড়তে বলেছিলেন বলে, দাবি করেন।

চোরের ভয়ে ঘরের ভেতরে দরজায় তালা লাগিয়ে ঘুমাতেন বেড়ামার্কেট এলাকার বস্তির বাসিন্দারা। গভীর রাতে যখন বস্তিতে আগুন লাগে তখন সবাই গভীর ?ঘুমে ছিলেন। তাড়াহুড়ো করে বেরুতে গিয়ে বিপত্তি সাধে দরজায় লাগানো তালা। ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে চাবি খুঁজে না পাওয়াতে এবং তালাও ভাঙতে পারেনি ফলে ঘরের ভেতর জীবন্ত দগ্ধ হতে হয়।

আগুন লাগার পর সবাইকে চিৎকার দিয়ে আগুনের কথা বলছিল রহিমা। তিনি সবাইকে ডাকার পর নিজের ঘরে যান মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকা নিয়ে আসতে। আমি নিষেধ করেছি, শুনেনি। শেষে তিন সন্তানসহ রহিমা পুড়ে মরেছে। যে আমাদের ডেকে দিয়ে বাঁচাল সে-ই মারা গেল, এটাই বড় আফসোস করতে লাগলেন বেঁচে যাওয়া রুমা আকতার।

বস্তির প্রবেশমুখের ‘সাত্তার কলোনিতে’ একটি মুদি দোকান করতেন সুরুজ আলীর স্ত্রী রহিমা। দোকান সংলগ্ন সেমিপাকা ঘরে চার সন্তান নিয়ে থাকতেন রহিমা। সুরুজ আলী আরেক স্ত্রী নিয়ে কাছেই আরেকটি কলোনিতে থাকেন। তার মেয়ে নাজমা আক্তারকে (১৬) বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছিল কক্সবাজার এলাকার এক ছেলের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কথা পাকা হওয়ার আগেই আগুনে ঝড়ে গেল নাজমাসহ একই পরিবারের চারজন। একই ঘরে থাকা রহিমার আরেক মেয়ে ব্র্যাক স্কুলে পড়া ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী নারগিস (১০) কোনো মতে প্রাণে বেঁচেছেন।

রহিমার মেয়ে নারগিস প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আগুন লাগার পর আমার মা চিৎকার করছিলেন আর দরজার তালা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দরজা ভাঙতে পারেননি। আমার ভাই জাকির দোকানের পেছনের দরজা ভেঙে দিলে আমি সেদিকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে প্রাণ বাঁচায়। ভাই মা বোনসহ কেউ আর বেরুতে পারেনি।’

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন জানান, ভোর রাত ৩টা ৩২ মিনিটের দিকে তারা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে অগ্নিকা-ের সংবাদ পান। ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটের ১০টি গাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে ভোর ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। মাত্র ৪৫ মিনিটের আগুনে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। মারা গেছে আটজন।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের টিম এসেছে। আমাদের পুলিশের টিমও গিয়েছে। আমরা রাস্তায় বেষ্টনী দেওয়াতে আগুন নেভাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি ফায়ার সার্ভিসকে। বস্তি সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি মার্কেট, দোকানপাট ও পোশাক কারখানা আছে। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আশায় সেগুলো রক্ষা পেয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন ও আহতদের খোঁজখবর নেন। জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকা-ের কারণ এখনো আমরা জানি না। এটা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা রান্নার চুলা থেকে হতে পারে। অথবা অন্য কোনো উৎস থেকেও হতে পারে। আমরা এটা তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছি। তারা তদন্ত করে দেখবে। এছাড়া নিহতদের প্রত্যকের দাফনসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

রোববার ক্ষতিগ্রস্ত ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা ওই বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। বলেন, চোর, মাদকাসক্তের উৎপাত আর অজানা আতঙ্কে ভেতর থেকে তালা মেরে বস্তির ঘরগুলোতে ঘুমাতেন ভাড়াটিয়ারা। এ কারণে আগুন লাগার পর যেমন তারা দ্রুত ঘর ছাড়তে পারেনি তেমনি মূল্যবান জিনিসপত্রও বের করতে পারেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সত্তার, জসিম, আহমদ উল্লাহ, হুজুর, আবদুর রহমানসহ ছয়জনের জমিদার হিসেবে দাবি করে আসলেও প্রকৃত পক্ষে ওই জায়গা তাদের নয়। এদের মধ্য সবচেয়ে বেশি দখলদার হিসেবে পরিচিত সাত্তার পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার মগবাজারে। অন্যরা থাকেন নগরীর বিভিন্ন নামিদামি আবাসিক এলাকায়।

অনেকে অভিযোগ করেন, সম্প্রতি কর্ণফুলী উচ্ছেদের কথা শুনে জমিদারের লোকজন ক্ষতিপূরণের আশায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এজন্য কোনো জমিদার সকাল পর্যন্ত তাদের খবর নিতে আসেনি।

সত্তারের কেয়ারটেকার লায়লা বেগম এ প্রতিবেদকে বলেন, আমার জমিদার ঢাকায় থাকেন। ওনার ৭৬টি ভাড়াঘর আছে। সবগুলোর দেখভাল আমি করি। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ভাড়াটিয়ার নিরাপত্তার কারণে রাতে তালা বন্ধ রাখতে হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close