নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই

না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত গীতিকার, সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর আফতাবনগরে নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন তিনি। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বুলবুলের মরদেহ রাখা হবে। এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। এফডিসিতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে কিংবদন্তি এই সংগীতজ্ঞকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হবে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গতকাল সকালে তার মৃত্যুর খবরে পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনেই শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় তিনি গভীর শোক প্রকাশ করে তার (বুলবুল) আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। দেশাত্মবোধক গানসহ বেশ কিছু গানের সুরস্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে ‘সব কটা জানালা’ গানটি শুনেননি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিনই হবে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বাংলা গানকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ‘একাত্তর’র মতোই তিনি আরেক সংগীতযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন অনেক জনপ্রিয় গান আছে, যা একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। বেশ দুরন্তপনার মধ্য দিয়ে একজন মানুষের ওই সময়টা কাটে। তখন তিনি ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলে পড়েন। ২৫ মার্চের ঘটনা তিনি নিজ চোখে দেখেছিলেন। এ রাতকে সবাই ‘কালরাত্রি’ বললেও বুলবুল সেই রাতকে ‘লাল রাত’ বলতেন। কারণ এ রাতে মানুষের রক্তে বাংলার মাটি লাল হয়েছিল। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে তার বন্ধুরা মিলে সাইকেলে চড়ে এসএম হল, জহুরুল হক হল, রোকেয়া হলসহ বিভিন্ন রাস্তার অলিগলিতে ছুটে গিয়েছিলেন। শত শত মানুষের লাশ আর তাজা রক্তের ছড়াছাড়ি দেখে সেদিন আঁতকে উঠেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদারদের ধ্বংস করতে তখনই যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বন্ধু সজীবের নেতৃত্বে বিহারিদের অস্ত্র ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে তাদের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই অস্ত্রের সহায়তায় তারা মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। পাশাপাশি তারা ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ টুলটুলের সঙ্গেও বেশ কিছু গেরিলা অপারেশনে অংশ নেন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ভারতে চলে যান। দেশে ফিরে সজীবের নেতৃত্বে আবার রাইফেল হাতে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন বুলবুল। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে আটক হয়ে একসময় পাশবিক ও লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল সংগীতবিষয়ক একটি বই লিখে অবসর সময়টা পার করছিলেন। বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘সার্কল অব সিক্সটিন্থ’। বইটি তিনটি খ-ে প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল বুলবুলের। এটি একটি গবেষণাধর্মী বই। তাই লিখতে একটু সময় লাগছিল তার। বইটির প্রথম খ-ে ৬২৫ পৃষ্ঠা, দ্বিতীয় খ-ে ৩০০ আর শেষ খ-ে ৩৫০ পৃষ্ঠা। প্রায় সাড়ে আট বছরের পরিশ্রমের ফসল তার এ বই। সংগীত অঙ্গনকে বইটি উপহার দিতে চেয়েছিলেন বুলবুল। কিন্তু সেটি আর নিজের মতো করে প্রকাশ করে যেতে পারলেন না। তার এই প্রস্থানের পরও সুরের নৈপথ্যে থাকা বাংলার সংগীতপ্রেমীরা যুগে যুগে খুঁজবেন প্রয়াত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা, গীতিকার ও সংগীত পরিচালককে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close