বদরুল আলম মজুমদার

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯

এরশাদ যুগের অবসান হচ্ছে!

জাতীয় পার্টিতে অবসান হতে চলেছে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যুগের। নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য গত দুই মাস থেকে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে আছেন। এবারের চিকিৎসা শেষ করে আদৌ এরশাদ রাজনীতিতে আর সক্রিয় হতে পারবেন কি না তা নিয়ে দলের মধ্যে সংশয় রয়েছে। যদিও বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ বছর দেশ পরিচালনা করে জাতীয় পার্টি। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলটি একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর এখন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায়। আর দেশের বহুল আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এরশাদ জীবনের শেষ সময়ে এসে এখন সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা।

এরশাদ বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান, এককালীন প্রধান সামরিক প্রশাসক ও পরে রাষ্ট্রপতি। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন কালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে দেশ শাসন করেন। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ঘোষণা দিয়ে তিনি ১৯৮৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে এলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান হন। এই নির্বাচনের আগেই তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে নিজের প্রতিষ্ঠিত পার্টির ব্যানারে নির্বাচন করে ৫ বছরের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন না থাকায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে স্বৈসাশক এরশাদ বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় প্রায় ৯ বছর কারাভোগ করেন।

পরে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরশাদ নানা চরিত্র নিয়ে দেশবাসীর সামনে হাজির হলেও রংপুরের মানুষের কদর থেকে বঞ্চিত হননি। প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। কিন্তু রংপুরের এরশাদ দেশের জাতীয় রাজনীনিতে ‘ভিন্ন রকম’ চরিত্রে অভিভূত হন। যদিও দলের একটি বড় অংশ মনে করে ফের কারাগারে যাওয়ার ভয়েই স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে পারেননি এরশাদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শুধুমাত্র নিজে বাঁচার জন্যই ব্যবহার করেছেন পার্টিকে। সংসদীয় গণন্ত্রাতিক ব্যবস্থায় এরশাদ প্রতিবারই ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হয়েছেন।

জাতীয় পার্টির সূত্র জানায়, প্রায় ৯০ বছর বয়সী এরশাদ আর জাতীয় পার্টির হাল ধরতে পারবেন কি না সন্দেহ। কারণ তিনি এখন ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। কাউকে চিনতেও কষ্ট হয়। বয়সের ভার এবং নানা রোগের কারণে জাতীয় পার্টিতে এরশাদ যুগের অবসান হতে চলেছে বলেই পার্টির নেতারা ধরে নিয়েছেন। এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি আর আগের অবস্থান নিয়ে থাকতে পারবে কি না এ নিয়ে নেতাদের মাঝে সন্দেহ আছে। কারণ এ পার্টি শুধুমাত্র ‘ওয়ান ম্যান শোতে’ পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। তারপরও দলটি এখন সংসদের প্রধান বিরোধী দল।

দলের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি কত দূর এগোতে পারবে তা নিয়ে অনেকের মতো আমিও সন্দিহান। কারণ দলে রওশন ও বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরর বনিবনা হয় না। দুজন দুই মেরুতে আছেন। তাছাড়া এরশাদের শেষ জীবনে এসে স্ত্রী রওশনও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এ অভিমান মূলত পার্টির কর্তৃত্ব নিয়েই। তিনি আরো বলেন, এর আগে জাতীয় পার্টির অনেক বাঘা বাঘা নেতা পার্টি থেকে গিয়ে আলাদা দল করেছেন, কেউ সফল হতে পারেননি। এরশাদের অবর্তমানে এই জাতীয় পার্টি যদি ভাগ হয় তাহলে দলটির আর কিছুই থাকবে না। অনেকে বলছেন, এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি তার অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রাখতে পারবে না।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভালো ও সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন তার উপ-প্রেস সচিব খন্দকার দেলোয়ার জালালী। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরশাদকে নিয়ে গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। এই মাত্র সিঙ্গাপুরে কথা বলেছি, আজ (মঙ্গলবার) তিনি অনেক ভালো বোধ করছেন।

এদিকে বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যুর সংবাদের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘মৃত্যুর’ গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসুস্থ এরশাদের পাশে কেউ নেই শিরোনামে একটি ছবি দিয়ে একাধিক পোস্ট ভাইরাল হয়। সেখানে লেখা হয় একসময়ের প্রতাপশালী এরশাদের স্বজনদের কেউই তার পাশে নেই। এমনকি স্ত্রী রওশন তার পাশে নেই বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

এরশাদের সুস্থতা কামনায় খতমে শেফা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইলে এ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে গত রোববার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) খালেদ আখতার, এরশাদের ছোট ভাই হুসেইন মোর্শেদ এবং হুসেইন মোর্শেদের স্ত্রী রুখসানা খান মোর্শেদ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য’ সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন এরশাদ। জয়ী হওয়ার পর দেশে ফিরে শপথও নেন। কিন্তু এরপর থেকেই তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। এরই মাঝে এরশাদের শারীরিক অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। দলীয় সূত্র জানায়, এরশাদের শারীরিক অবস্থা খুবই নাজুক। চার দিন পরপর তাকে রক্ত দিতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরে রক্ত উৎপাদন কমে গেছে।

এদিকে এরশাদের অবর্তমানে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিদেশে থাকাকালীন পার্টির বর্তমান কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত ১৬ জানুয়ারি এ নিয়োগ প্রদান করেন, যা এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদে এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়। একই সঙ্গে প্রজ্ঞাপনে জিএম কাদেরকে সংসদীয় বিরোধী দলের উপনেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এরশাদের অসুস্থতার বিষয়ে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা চলছে, আশা করি দ্রুতই সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close