জুবায়ের চৌধুরী

  ২১ জানুয়ারি, ২০১৯

আদালতে হামলা করে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা

গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গিরা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গত দুই বছরে একাধিক সংগঠনের শীর্ষ জঙ্গিরা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করছে। তবে কারাবন্দি অবস্থাতেই সংগঠনকে চাঙা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা। আবার এই দুই বছরে তিন শতাধিক জঙ্গি জামিনে বেরিয়ে গেছে। তারাও গোপনে সংগঠনকে সক্রিয় করার পাঁয়তারা করছে। এসবের মধ্যে অভিযান চালিয়ে ধরা হয়েছে বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গিকে। লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের গ্রেফতার করে সক্ষমতা দেখিয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে গাজীপুরের টঙ্গী বোর্ডবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জঙ্গি রিপন গুলশান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড তামিম-সারওয়ার গ্রুপের শূরা সদস্য হিসেবে কাজ করত। রিপনকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব জানিয়েছে, আদালতে হামলা করে জঙ্গি নেতাদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিল জঙ্গিরা। এ জন্য তারা ছক কষেছিল। নিজেদের ভেঙে পড়া নেটওয়ার্ক জোড়াতালি দেওয়ার নতুন এই কৌশলে বা তাদের নিজেদের ভাষায় ‘দ্বিতীয় ধাপে’ নিয়ে আবার সংঘবদ্ধ হয়ে এগোতে চাইছে জঙ্গিরা। সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে চাঞ্চল্যকর জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ জঙ্গি আসাদুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদেও একই ধরনের তথ্য পেয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের গোয়েন্দারা।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার মুহিবুল ইসলাম খান জানান, জঙ্গিদের নতুন নতুন কৌশল থাকলেও পুলিশ পাল্টা কৌশল নিয়ে তাদের প্রতিরোধের সক্ষমতা রাখে। নিবিড় তদারকির কারণে উগ্রপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না। অনলাইনে মনিটরিংয়ের জন্যও রয়েছে পৃথক টিম।

আদালত ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হামলার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের : হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার আসামিদের ছিনতাই করতে আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজনভ্যানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের। একইসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হামলা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনাও ছিল তাদের। গতকাল রোববার গ্রেফতার জেএমবি নেতা মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান র‌্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) মুফতি মাহমুদ খান। গত শনিবার রাতে গাজীপুরের টঙ্গী বোর্ডবাজারের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রিপন তামিম-সারওয়ার জঙ্গি গ্রুপের শূরা সদস্য হিসেবে কাজ করত।

র‌্যাবের মুফতি মাহমুদ জানান, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর প্রায় দেড় বছর দেশের বাইরে আত্মগোপনে ছিল রিপন। গত বছর দেশে ফিরে জেএমবিকে পুনর্গঠনের কাজ করছিল। একইসঙ্গে হলি আর্টিজান হামলা মামলার আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া-আসার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা করে তাদের ছিনতাই করার পরিকল্পনা ছিল তার। ২০১৪ সালের ত্রিশালের ঘটনার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবি সদস্যরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্পর্শকাতর স্থান ও আদালত প্রাঙ্গণে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করেছিল। যেন বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ভেতর ভীতির সঞ্চার হয়। সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা যায়।

মুফতি মাহমুদ খান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিপন জানিয়েছে, তিনি ৩৯ লাখ টাকা সারওয়ার জাহানকে দিয়ে হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনা ও অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ ছাড়া উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংঘটিত হয়েছে। ২০১৩ সালে বগুড়ার সাইবারটেক কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় রিপনের সঙ্গে ডা. নজরুলের পরিচয় হয়। নজরুলের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়েই রিপন জঙ্গিবাদে জড়ায়। এরপর রিপনকে অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্থানীয় একটি বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ টাকা, সিগারেট বিক্রেতার কাছ থেকে ১ লাখ এবং অন্য এক ঘটনায় ১ লাখ টাকা ছিনতাই করে সংগঠনকে দেয় রিপন।

জঙ্গি রিপন ৫ দিনের রিমান্ডে : গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন ওরফে রেজাউল করিম ওরফে রেজাকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক প্রণব বড়–য়া এ আদেশ দিয়েছেন। এ দিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কফিল উদ্দিন আসামিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে আদালত আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ফের সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা : দীর্ঘদিন জঙ্গি নির্মূলে কাজ করছেন এমন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরনো সব কৌশল আমূল বদলে নতুনভাবে সংগঠনকে সক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে জঙ্গিরা। আগে যেখানে টার্গেট ছিল ব্যক্তি; এখন সেখানে জঙ্গিদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হামলা। গ্রেফতার এড়াতে কোনো মেস বা বাসাবাড়িতে একসঙ্গে দুজনের বেশি অবস্থান করছে না তারা। সংগঠনের নতুন সদস্য রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে মাদ্রাসা ছাত্রদের। কলাবাগানে চাঞ্চল্যকর জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ জঙ্গি আসাদুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ এসব তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

জঙ্গি কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছেন, এমন এক কর্মকর্তা জানান, আনসার আল ইসলাম এখন অনলাইনে দাওয়াতের মাধ্যমে তাদের সংগঠনের জন্য নতুন লোক রিক্রুট করছে। দলভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তার পরীক্ষা নেওয়া হয় অনলাইনেই। ‘হিজরত’ করার প্রাথমিক পরীক্ষাও চলে অনলাইনে। ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জনকে আনসার আল ইসলামে রিক্রুট করেছে আসাদুল্লাহ। টার্গেট ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করার প্রশিক্ষণও তাদের দিয়েছে আসাদুল্লাহ। তাদের ভাষায়, এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়াকে ‘আসকারি’ ট্রেনিং বলা হয়ে থাকে। হঠাৎ জঙ্গিবাদে মাদ্রাসা ছাত্রদের রিক্রুটের কারণ সম্পর্কে আসাদুল্লাহ জানিয়েছে, অধিকাংশ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ থাকে না। অনেকে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করে না। তাই তাদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দিয়ে অপারেশনে পাঠানো যায়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে ফেলে। ওই রাতে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর একে একে অর্ধশত অভিযান চালিয়ে দেড় শতাধিক জঙ্গি নিহত ও সহস্রাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close