​শাহ্জাহান সাজু

  ২০ জানুয়ারি, ২০১৯

খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংক আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান ও আদায়ে সরকারি টাস্কফোর্স গঠন, অবলোপন (রাইট অফ) ঋণ আদায়ে লিগ্যাল অ্যাকশন টিম গঠন, ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব ঋণখেলাপি শনাক্ত করা, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ব্যাংকারদের যোগসাজশ আছে কিনাÑ তা চিহ্নিত করা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব চাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খেলাপিকে আদালতে যেতে হলে বকেয়ার ৫০ শতাংশ অগ্রিম জমা দেওয়ার বিধান করা হচ্ছে। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) সম্প্রতি এ নির্দেশনা দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন পদ্ধতি চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী অর্থবছর থেকে এ পদ্ধতিই অনুসরণ করবে ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, নতুন পদ্ধতি ‘ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিংয়ের (আইসিআরআর)’ মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয় সঠিকভাবে বের করা যাবে। এছাড়াও ব্যাংকের সব ঋণ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়েও ধারণা পাওয়া যাবে। এ পদ্ধতিতে খাত ভিত্তিক ঝুঁকিও বের করা যাবে।

সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হ্রাসসহ এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন।

সূত্র জানায়, কীভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়Ñ তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তবে সংশোধনের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার ব্যাংক কোম্পানি আইনকে অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া ব্যাংকের লেনদেন অধিক স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা নিশ্চিত করতে ব্লক চেইন টেকনোলজি ব্যবহার করার কথা বলেছেন তিনি। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দিতে বলা হয়।

এদিকে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী অর্থবছর থেকে ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে বলা হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পদ্ধতি ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিংয়ের (আইসিআরআর) মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়টি সঠিকভাবে বের করা যাবে। আবার ব্যাংকের সব ঋণ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়েও ধারণা পাওয়া যাবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের ঝুঁকি কমে আসবে।

জানা যায়, ঋণঝুঁকি নির্ধারণে ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা ‘ক্রেডিট রিস্ক গাইডলাইন ম্যানুয়াল (সিআরজিএম)’ শীর্ষক নীতিমালা অনুসরণ করে ঋণ দিয়ে আসছিল। তবে নতুন পদ্ধতি চালুর আগে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত সিআরজিএম ও আইসিআরআর একসঙ্গে অনুসরণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে কেবল আইসিআরআর অনুসরণ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো এখন থেকে প্রত্যেক ঋণ গ্রহীতার একটি রেটিং এবং তথ্যভান্ডার তৈরি করবে। এ রেটিংয়ে সক্ষমতার মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে ভাগ করবে ব্যাংকগুলো। সেখানে কোনো গ্রাহক ‘এক্সিলেন্ট’ রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে ঋণ দিতে পারবে। তাছাড়া ‘গুড’ রেটিং পেলেও ব্যাংক তাকে ঋণ দিতে পারবে। আর ‘মার্জিনাল’ রেটিংধারী গ্রাহককে পুরানো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ব্যাংককে। এছাড়া ‘আনএকসেপ্টেবল’ রেটিংধারী নতুন পাবেন না। এ শ্রেণির গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দুইবার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে।

নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, রেটিং করার ক্ষেত্রে একটি পার্টি বা গ্রাহকের পরিমাণগত সক্ষমতায় ৬০ শতাংশ নম্বর এবং গুণগত সক্ষমতায় ৪০ শতাংশ নম্বর থাকবে। পরিমাণগত সক্ষমতা সূচকে ৬০ নম্বরের মধ্যে মোট গৃহীত ঋণ ও আর্থিক সক্ষমতায় ১০, চলতি দায় ও তরল সম্পদে ১০, মুনাফার সক্ষমতায় ১০, সুদ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ প্রবাহের ওপর ১৫, পরিচালনগত দক্ষতায় ১০ এবং ব্যবসার মানের ওপর পাঁচ নম্বর থাকবে। এছাড়া গুণগত সক্ষমতায় ৪০ নম্বরের মধ্যে কার্যদক্ষতার আচরণে (পারফরম্যান্স বিহেবিয়ার) ১০, ব্যবসা ও খাত ঝুঁকিতে ৭, ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে ৭, জামানত ঝুঁকিতে ১১, সম্পর্ক ঝুঁকিতে ৩, পরিপালন ঝুঁকিতে ২ নম্বর থাকবে।

জানা যায়, কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘আনএক্সসেপ্টেবল’ রেটিং দেওয়া হবে। নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে নতুন ঋণ, ঋণ নবায়ন ও বিদ্যমান ঋণ বর্ধিতকরণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অবশ্যই এ রেটিং করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। তবে কোন কোন খাতের গ্রাহকের রেটিং করতে হবে, তার কিছু খাত-উপখাত নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শিল্প খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, রাসায়নিক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা, পাটকল, ইস্পাত প্রকৌশল, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে, কৃষিভিত্তিক ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সেবা খাতের আবাসন ও নির্মাণ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, টেলিকমিউনিকেশন ও অন্যান্য সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ঋণ দিতে হবে। তবে ভোক্তা ঋণ ৫০ লাখ টাকার কম আছে, এমন ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ, ক্ষুদ্রঋণ, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং অনুসরণ করতে হবে না।

জানা যায়, আইসিআরআর নীতিমালায় এমন ২০টি মডেল দেওয়া আছে, যা কার্যকরভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ মডেল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close