নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৯

৪০ কোটি টাকা গচ্চা

খাল পরিষ্কারের সুফল মিলছে না ঢাকাবাসীর

৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭টি খাল পরিষ্কার করা হলেও এর সুফল পাচ্ছেন না ঢাকাবাসী। শুষ্ক মৌসুমে ময়লার ভাগাড় হওয়া খালগুলো বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারে না। নগরবিদরা বলছেন, সমন্বয়হীনভাবে উন্নয়নের কারণেই অর্থের অপচয় হচ্ছে প্রতি বছর। ওয়াসার দাবি, উদ্ধার জটিলতা, বর্জ্য ফেলা অব্যাহত থাকা ও জনগণের অসেচনতার কারণে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

পরিষ্কারের পর দুই মাসে আবারও একই চিত্র হয়েছে ইব্রাহিমপুর খালের। মিরপুরের সাংবাদিক কলোনিসহ অন্য খালেরও একই দশা। ওয়াসার হিসেবে প্রতিটি খালে গড়ে পৌনে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল।

স্থানীয়দের অভিযোগ, খনন না করে কেবল ভাসমান ময়লা তুলে ফেলায় কোনো উপকারই হয়নি তাদের। ময়লা, পলিথিন ও ডাবের খোসা ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না, যতটুকুই খননের কাজ হয়েছে তাতে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ আরো বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কাজ শেষ না করেই চলে গেছেন তারা। পরিষ্কার করার পরও মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাসাবোসহ প্রায় সব খালই বর্জ্যে ভরপুর। তবে বর্জ্য ফেলার দায় অন্য এলাকার বাসিন্দাদের ওপর চাপান স্থানীয়রা। তাদের দাবি ওয়াসা প্রতি বছর ভাসমান ময়লা তুলে ফেললেও খনন করে না কখনো। এমন কার্যক্রমকে অর্থ লোপাটের ফন্দি হিসেবেই মন্তব্য করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।

ওয়াসার ৪৬টি খালের মালিকানা কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে এর অনেকই সরু নালায় পরিণত হয়েছে। নগরবিদদের আশঙ্কা, দখল-দূষণমুক্ত না হলে বাকিগুলো অস্তিত্ব হারাবে।

ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো অবৈধ দখল ও ভরাটের কারণে বিলুপ্তির পথে। ৫৮টি খালের মূল আয়তনের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় খালের জায়গা দখল হয়েছে। বর্তমানে যে অবস্থায় সেবা সংস্থাগুলো চলছে এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা শহরে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এজন্য গত বছর বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) এক গবেষণায় উঠে আসে ঢাকায় ৫৮টি খালের মধ্যে এখানো ২৬টি সচল করা সম্ভব। তবে খালগুলো দ্রুত দখলমুক্তের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সংস্থাগুলোকে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ খাল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দখলে। রূপনগর খালটির বড় একটি অংশ ভরাট করে বানানো হয়েছে রাস্তা। দিয়াবাড়ী, বাউনিয়া ও আবদুল্লাহপুর খালে মাছের ঘের ও দুই পাশে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। ১০০ ফুটের খালটি ৬৫ ফুটে পরিণত হয়েছে, মহাখালী খালে ২৩টি অবৈধ স্থাপনা, মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদী ও রামচন্দ্রপুর খাল ১১০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৫০ ফুট, ইব্রাহিমপুর খালে ৫০টি স্থাপনা, কল্যাণপুর ঘ, ঙ খালে ওপর ৫২টি স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। এতে ১২০ ফুটের খালটি মাত্র ৪২ ফুটে এসেছে। কল্যাণপুর ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ ও শাহজাদপুরের খালে অবস্থা নাজুক, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহিনী খালে গড়ে উঠেছে স্থানীয় জাতীয় পার্টি, জেলা পরিষদ মার্কেট মসজিদ, নন্দীপাড়া যুব সংঘ, নন্দীপাড়া ক্রীড়া সংসদ, নন্দীপাড়া মল্লিকা ক্লাব, নন্দীপাড়া খালপাড়া পাঞ্জেখানা মসজিদ গড়ে উঠেছে।

কুতুবখালী খালের একপাশে রাস্তা, অন্য পাশে দোকান। কামরাঙ্গীরচর খাল পান্নাবেটারীর দখলে। কালুনগর খালটি স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। ভাটারা ও ডুমনী খাল একটি সুনামধন্য গ্রুপের দখলে। শুভাঢ্যা খালে গড়ে উঠেছে শুভাঢ্যা জামে মসজিদ কমিটি, গোলাম বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি, মসজিদ মার্কেট কমিটি, বায়তুল হামদ জামে মসজিদ মার্কেট। এছাড়াও বোয়ালিয়া ও নন্দীপাড়া খালে আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, রাজধানীতে যেসব সেবা সংস্থা রয়েছে সবই যদি সমন্বিতভাবে খাল দখল উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও কোনো সফলতা পাওয়ায় যাবে না। খাল দখলমুক্ত রাখতে চাইলে সবার আগে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির দরকার বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। ঢাকায় এক শতাংশ জায়গার দাম কোটি টাকার ওপরে। সেখানে খালের জায়গা বিনা টাকায় দখল করতে পারলে সমস্যা কোথায়। আর ৫৮টি খাল গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। এসব জায়গা স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অবৈধভাবে বাড়িঘর, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছেন। এসব দখলবাজদের থাবায় ছোট হয়ে এসেছে খালগুলো। প্রথমে আবর্জনা পরে মাটি ফেলে ভরাট করে নির্মাণ করছে ছোট ছোট টিনশেড। পরে সুযোগ বুঝে খালের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা ভবন আর দোকানপাট। তবে দখল ব্যবসায় কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন সেবা সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, প্রতিটি কাজ হয়েছে তবে কাজ শেষ হয়নি। কাজের শেষ বলতে তো কিছু নেই মাত্র ১৭টি খাল খনন কাজ শুরু করেছি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, খাল কর্তৃপক্ষ ও দখলদার দুই পক্ষই খাল নিয়ে খেলা খেলছে। খাল দখল যারা করছেন তারাই আবার উচ্ছেদ করছেন। দুইটিই ওদের লোক। এতে দখলেরও সুবিধা, উদ্ধারেরও সুবিধা। দখল হওয়ার সময় একবার ভাগবাটোয়ারা পায় আবার উদ্ধারের সময়েও মোটা অঙ্কের অর্থ পায়। সুতরাং খাল দখল ও উদ্ধার দুইটিই নতুন অর্থ আয়ের উৎস হয়েছে। খাল কর্তৃপক্ষের সামনেই দখল হচ্ছে। যে খাল উদ্ধার করা হলো সেটি আবারও দখলে। সেখানে দখলদারদের কেন বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে না? কেন তাদের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ নিচ্ছে না?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close