গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৩ জানুয়ারি, ২০১৯

স্বীকৃতি পাওয়া নির্ভর করছে স্পিকারের ওপর

বিরোধী দলে কারা

জাতীয় সংসদের ৩৯৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৬৬টি। এদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে আট দলের প্রার্থীরা পৃথকভাবে বাকি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত দল জাতীয় পার্টি; আসন ২০টি। এতে সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা কোন দল পাবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এবার সংসদে বিরোধী দল হওয়ার জন্য সরকারের বাইরের কোনো দলকে স্পিকারের সুবিবেচনার ওপর নির্ভর করতে হবে।

সংবিধান ও সংসদীয় কার্যপ্রণালিবিধিতে সংসদের বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে এককভাবে কটি আসন পেতে হয়, তা সুনির্দিষ্ট করা না থাকলেও, পাশের দেশ ভারতের লোকসভার বিধান এবং প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী বিরোধী দলের স্বীকৃতির জন্য ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন পেতে হবে। এবারের সংসদে ন্যূনতম দ্বিতীয় কোনো দল এককভাবে ওই সংখ্যক আসন না পাওয়ায় বিরোধী দলে বসতে হলে আসনপ্রাপ্ত দলগুলোকে স্পিকারের ওপর নির্ভর করতে হবে। এর আগে বিরোধী দল ছিল না স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ও ষষ্ঠ সংসদে। আর চতুর্থ সংসদে বিরোধী দল করা হয় বিশেষ বিবেচনায়।

বিগত সংসদের ইতিহাস পর্যালোচনায় পাওয়া প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রথম সংসদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদ নেতা নির্বাচিত হলেও ওই সংসদে কোনো বিরোধী দল বা বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন না। মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ষষ্ঠ সংসদও চলছে বিরোধী দল ছাড়াই। সরকারি দলের বাইরে থাকা কোনো দল প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন না পাওয়ায় বিরোধী দল বা তাদের নেতা নির্বাচিত হননি। তবে ১৯৮৮ সালে বিশেষ বিবেচনায় কটি দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলকে বিরোধী দল এবং তাদের নেতা আ স ম আবদুর রবকে বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এবার অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা।

সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধিতে সংসদের বিরোধী দল থেকে ঠিক কতসংখ্যক সদস্য প্রয়োজন, তা নির্ধারিত নেই। তবে ভারতের লোকসভার বিধান ও প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী বিরোধী দলের স্বীকৃতির জন্য ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন পেতে হবে। প্রথম, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদে সরকার দলের বাইরে কোনো দল প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন পায়নি। যে কারণে প্রথম ও ষষ্ঠ সংসদে কোনো বিরোধী দল বা বিরোধী দলের নেতা ছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে প্রথম সংসদে ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল একটি বিতর্কও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী গ্রুপের স্বীকৃতি মিললেও বিরোধী দল বা নেতা স্বীকৃতি মেলেনি। সংসদ অধিবেশনের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ওই সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী পাঁচ থেকে সাতজন সংসদ সদস্য মিলে একটি গ্রুপ গঠন করেন। সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানকে তারা নেতা নির্বাচিত করেন। বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের পাশাপাশি ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দল বা গ্রুপের সর্বোচ্চ সংখ্যক নিয়ে গঠিত দল বা গ্রুপের নেতাকে সংসদের স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন।

ওই বক্তব্যে আপত্তি জানান তৎকালীন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আতাউর রহমান খান, একা এক দলের একজন, আরেক দলের একজন এবং আরো কয়েকজন নির্দলীয় সদস্য মোট ৫ থেকে ৭ জন একটি কক্ষে বসতে চেয়েছেন এবং তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় কনভেনশন অনুযায়ী পাঁচ-সাতজন সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো গ্রুপের নেতাকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।’ আলোচনায় ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো দলকে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সংসদের বিরোধী দল ও বিরোধীদলীয় নেতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই একমাত্র নির্দেশনা। ওই বক্তব্যে প্রথম সংসদে প্রস্তাব উত্থাপনকারী সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খানও বিরোধিতা করেননি। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও প্রচলিত রেওয়াজ উপেক্ষা করে চতুর্থ সংসদে বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ওই সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নেতা আ স ম আবদুর রব সংসদের অন্য দলগুলোকে নিয়ে কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিস (কপ) বা সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন করেন। কিন্তু তাদের দখলে ছিল ১৯ আসন। কপ প্রথমে সংসদীয় গ্রুপের মর্যাদা লাভ করলেও বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করেনি। পরে আরো ১৪ জনসহ মোট ৩৩ জন সংসদ সদস্য আ স ম আবদুর রবকে নেতা মেনে নিয়ে স্পিকারের কাছে আবেদন পেশ করলে স্পিকার তাকে বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি দেন। সেই হিসেবে একাদশ সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতি স্পিকারের ওপর নির্ভর করছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টিকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে অন্য ছোট দলগুলোর সমর্থন আদায় করে ১০ শতাংশ সদস্যের স্বীকৃতি নিতে হবে। নির্বাচনে বর্তমান বিরোধী জাতীয় পার্টি ২০টি আসন পেয়েছে। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট ৭টি আসন পেয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো দল ৩টির বেশি আসন পায়নি।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী ২(১)(ট) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’ সে হিসেবে বিরোধী দলের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি স্পিকারের একক এখতিয়ারের বিষয়।

তবে, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান, জাতীয় পার্টি যেহেতু দলগতভাবে আওয়ামী লীগের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, তাই জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসবে। আর সংবিধান ও কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের লোকসভার কার্যপ্রণালিবিধিতেও বিরোধী দলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে সেখানে ১০ শতাংশ সদস্য না থাকায় প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লোকসভায় কোনো বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের নেতা ছিলেন না বলে খন্দকার আবদুল হকের ‘সংসদীয় দল ও অধিসংঘের স্বীকৃতি’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, লোকসভার কার্যপ্রণালিবিধির ৩৮৯ বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্পিকার সময়ে সময়ে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে বিষয়টি সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গড়ে উঠেছে। সেখানে সংসদীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে ৫৪৫ সদস্যের লোকসভার কমপক্ষে এক দশমাংশ সদস্য নিয়ে গঠিত হতে হবে। আর সংসদীয় গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দলে কমপক্ষে ৩০ জন সদস্য থাতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close