শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

২৬ বছরেও মামলার ফলাফল লেখা হয়নি ‘স্যুট রেজিস্ট্রার ও রুল বইয়ে’

রায়ের নথি নিয়ে লুকোচুরি!

চট্টগ্রামের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে রাঙ্গুনিয়ার একটি ডাকাতির মামলা ১৯৯১ সালের ৩২ নম্বর দায়রা মামলা হিসেবে বিচার শেষ হয়েছে ২৬ বছর আগে। তবে আদালতে আবেদন করেও মামলাটির ফলাফল জানা যাচ্ছে না। এই রায়ের নথি নিয়ে লুকোচুরি চলছে আদালতে। অভিযোগ রয়েছে, ওই ডাকাতি মামলাটির রায়ে চট্টগ্রামের পঞ্চম সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী আবুল কালাম আজাদের ছোট ভাই আবদুস ছালামের ১৮ বছর সাজা হয়েছিল। সাজাপ্রাপ্ত এই আসামিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে সেই মামলার নথিপত্র নিয়ে লুকোচুরি করার অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডাকাতির অভিযোগে আবুল কালাম আজাদের ভাই আবদুস ছালামের বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে রাঙ্গুনিয়া থানায় দন্ডবিধির ৩৯৫ ও ৩৯৭ ধারায় একটি মামলা হয়। যার মামলা নং ৮(১১)৮৭। পরবর্তীতে ওই মামলা ১৯৯১ সালের ৩২ নম্বর মামলা হিসেবে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ২৮ অক্টোবর মামলাটি বিচার নিষ্পত্তি হয়। তবে রুল বইয়ে মামলাটির নথি ২০০০ সালের ১৮ মে ৩৬ নম্বর স্মারকে জেলা রেকর্ড রুমে প্রেরণ করা হয়েছে উল্লেখ থাকলেও গ্রহণ করার তথ্য নেই। এদিকে, নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রামের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের রুল বইয়ে মামলার রায়ের ফলাফল ও নথির সর্বশেষ অবস্থান লিপিবদ্ধ থাকার কথা। একইভাবে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের স্যুট রেজিস্ট্রারেও রায়ের ফলাফলের নোট থাকার কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রায় ঘোষণার দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় পার হলেও এখনো ‘স্যুট রেজিস্ট্রার ও রুল বইয়ে’ মামলার ফলাফল নোট লেখা হয়নি।

এদিকে, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ১৯৯১ সালের ৩২ নাম্বার মামলার রায়ের নথি না থাকলেও আগে ও পরের সিরিয়ালের ৩১ ও ৩৩ নাম্বার মামলার রায়সহ সব তথ্য ‘রুল বই ও স্যুট রেজিস্ট্রারে’ উল্লেখ আছে। ব্যতিক্রম কেবল ওই ৩২ নাম্বার মামলাটি। উক্ত মামলার রায়ের নকল পাওয়ার জন্য ২০১৭ সালের ১৯ মে আবেদন (১৬০০/১৭) করেছিলেন চট্টগ্রাম আদালতের একজন আইনজীবী। এরপর ‘দরখাস্তে বর্ণিত নথি নিষ্পত্তি মতে রুল বইতে না থাকায় প্রসেস দেওয়া গেল না’ উল্লেখ করে নকল আবেদন খারিজ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রায় প্রদানকারী দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের পেশকার মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী রায় ঘোষণার পর আদালতের রুল বইয়ে রায়ের তারিখসহ ফলাফলের নোট থাকে কিন্তু ৩২ নাম্বার মামলায় কেন নেই সেটি আমরা সঠিক বলতে পারছি না।’

১৯৯১ সালের ৩২ নাম্বার মামলার রায়ের তথ্য না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার আবু তাহের বলেন, ‘স্যুট রেজিস্ট্রারে সব মামলার ফলাফল কলামে তথ্য থাকলেও ৩২ নাম্বার মামলাটির তথ্য নেই। তবে নিয়ম অনুযায়ী তথ্য থাকার কথা। ১৯৯১ সালের ৩১ ও ৩৩ নাম্বার মামলার তথ্য আছে। শুধু ৩২ নাম্বার মামলার তথ্য না থাকার কারণ আমি জানি না।’

আদালতের মহাফেজখানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘রায়ের তারিখ ও সাল অনুযায়ী আমরা রেকর্ড সংরক্ষণ করি। ১৯৯১ সালের ৩২ নাম্বার এই মামলার রায়ের তারিখ অনুযায়ী নথি পাওয়া যাচ্ছে না।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সন্ত্রাসমূলক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় পেশকার আবুল কালামের ছোট ভাই আবদুস ছালামের। একই মামলায় তার অপর ভাই আলমগীরের সাজা হয় ১০ বছর। রায় ঘোষণার সময় তারা পলাতক ছিলেন। পরে তারা ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ২০০১ সালে একটি রিট আবেদন করেন উচ্চ আদালতে, যার নম্বর ৬৯২৩।

অভিযোগ আছেÑ পেশকার আবুল কালাম আজাদের পরামর্শ ও কূটকৌশলে রিটটি করা হয়। ১৮ বছর ধরে এই রিটের রুল নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। ওই মামলায় শুরুতে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ নেয় আসামিরা। নিয়ম অনুযায়ী স্থগিতাদেশ বর্ধিত করার কথা। অথচ কোনো ধরনের বর্ধিত স্থগিতাদেশ ছাড়াই এই মামলা ১৮ বছর ধরে বিচারাধীন আছে।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা সোবহান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন আইয়ুব ও শামসু। এই দুজন আবদুস ছালামের নাম জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দেয়। কিন্তু আইয়ুব ও শামসুরের সাজা হলেও খালাস পেয়ে যান আবদুস ছালাম। মুক্তিযোদ্ধা সোবহানের দুই সন্তান ছবুর ও কবিরকে এসিড নিক্ষেপ করার ঘটনায়ও আবদুস ছালাম ও তাদের অপর ভাই জাহাঙ্গীর জড়িত ছিলেন বলে আইয়ুব ও শামসুর স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে। কিন্তু তারা দুজনও খালাস পান।

অভিযোগ প্রসঙ্গে পঞ্চম সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আদালতের নথি গায়েব করার কোনো প্রকার সুযোগ নেই। মামলার রায়ের তথ্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শাখায় থাকবে।’ আবদুস ছালামের বিরুদ্ধে ওই মামলাটি ২০০১ সালে আপিলের পর এখনো বিচারাধীন বলে দাবি করেন তার ভাই পেশকার আবুল কালাম আজাদ।

অন্যদিকে অভিযুক্ত আবদুস ছালাম বলেন, ২০০০ সালে আপিলের পর ২০০৫ বা ২০০৬ সালে ৩২ নাম্বার মামলাটিতে হাইকোর্ট থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। ওই মামলায় তার ১০ বছর সাজা হয়েছিল বলেও জানান ছালাম।

পেশকার আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন তার ভাই আবদুস ছালামের ৩২ নাম্বার মামলাটির এখনো আপিল চলছেÑ এ প্রসঙ্গ তুলে ধরার পর আবদুস ছালাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, পরে বলেন, ‘এত কথা বলার দরকার তো ছিল না। কিছু বলার থাকলে আপনি কোর্টে বলুন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close